বাংলাদেশের পশ্চিমের এক আমবাগান। ভারত সীমান্ত থেকে থেকে দূরত্ব মাত্র ৩০০ গজ। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার এ জায়গাটি ৫৩ বছর আগের ইতিহাসের এক বাঁক বদলের সাক্ষী।
দেশজুড়ে যখন মুক্তির জন্য মরণযুদ্ধ তখন অখ্যাত এই আমবাগান হঠাৎ সরগরম। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজির শতাধিক সাংবাদিক। গার্ড অব অনারের জন্য প্রস্তুত বিশেষ বাহিনী। প্রস্তুত ঘোষণা মঞ্চ, সবমিলিয়ে এক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা নতুন এক বাংলাদেশের সরকারের জন্য।
খুব বেশি আড়ম্বরপূর্ণ ছিলো না সে আয়োজন। তবে উৎসাহের কোন কমতি ছিলো না। একে একে ঘোষণা হলো প্রবাসী সরকারের কাঠামো। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। আর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। শপথ পড়ান গণপরিষদের স্পিকার ইউসুফ আলী, তিনিই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। যেখানে বলা হয়, জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা হলো সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
শপথ পর্ব শেষ করে বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দিন আহমদকে সরকার গঠনের পরামর্শ দেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
ঝিনাইদহ মহকুমার তৎকালীন পুলিশ প্রশাসক মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যুদ্ধ শুরুর আগে ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দিন আহমদকে গঠনের জন্য বলেছিলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠন করলে সেটি বৈধ হবে বলেও জানিয়েছিলেন।’
তবে শপথ অনুষ্ঠান ভূণ্ডলে তৎপর ছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তাই পাকিস্তান বাহিনীর নজর এড়িয়ে সীমান্তঘেঁষা এক আমবাগান বেছে নেয়া হয়।
তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘আসলে ১৪ তারিখে শপথ নেয়ার কথা ছিলো। বিদেশে সাংবাদিকদেরও বলা হয়েছিল। কিন্তু তখন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জেনে যায়, আর সেদিন প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ করা হয়েছিল।’
বঙ্গবন্ধু সে সময় পাকিস্তান করাগারে বন্দি থাকলেও তাকে কেন্দ্র করেই দেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়।
মুজিবনগর সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। নিজেদের ঐক্য ধরে রেখে ভারত সরকারের সঙ্গে সমন্বয়, আন্তর্জাতিক জনমত গঠনসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে এই সরকার।
সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘পাকিস্তান সরকার সবসময় এটিকে (মুক্তিযুদ্ধ) বিচ্ছিন্ন একটি আন্দোলন হিসেবে দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জন্যই তখন এই সরকার গঠন করা হয়েছিলো।’
১৭ এপ্রিল শপথ নেয়া সরকারের নেতৃত্বেই শত্রুমুক্ত হয় দেশ। আর পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।