রাজনীতি
দেশে এখন
0

এতো স্বগৌরব ইতিহাস, তবুও কেন প্রশ্নের মুখে ছাত্ররাজনীতি

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান কিংবা একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের ইতিহাসে কোথায় অবদান নেই ছাত্র আন্দোলনের! ইতিহাস বলে, স্বাধীনতা পরবর্তী গণতান্ত্রিক সংগ্রামেও নেতৃত্ব দিয়েছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

স্বাধীনতার ৫০ পেরিয়ে হঠাৎ কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের তোড়জোড়? যেখানে বহির্বিশ্বে আজও অধিকার আদায়ের অন্যতম হাতিয়ার শিক্ষার্থীদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন। তবে কি ষড়যন্ত্রের ঘোরপ্যাঁচে আবর্তিত হচ্ছে গৌরবান্বিত ছাত্র রাজনীতি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনকেই ছাত্ররাজনীতির আতুর ঘর বলা হয়। যেখান থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিভিন্ন দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। সারা বিশ্বেই যখন ছাত্ররাজনীতির অবস্থান রয়েছে, সে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কেন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হচ্ছে। এবং সেটি আসলে কতটা যৌক্তিক?

মধুর ক্যান্টিন, এখান থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ছবি: এখন টিভি

সম্প্রতি বুয়েট ক্যাম্পাসে একটি ছাত্র সংগঠনের সভাপতির প্রবেশ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ঘোলাটে পরিস্থিতি। সেখানে বিগত ৪ বছর ধরে নিষিদ্ধ ছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এই প্রেক্ষাপটে সেখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতি নিষিদ্ধের আন্দোলন, অন্যদিকে আদালতের নির্দেশ রাজনীতিতে বাঁধা নাই, এমন সব পরিস্থিতিতে সব মহলে চলছে তুমুল বিতর্ক।

ছাত্ররাজনীতির অস্তিত্ব যে শুধু বাংলাদেশেই আছে তা নয়। সারাবিশ্বেই এটি আছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। ইউরোপের দেশগুলোয় শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে ছাত্র সংসদগুলো কাজ করে থাকে। এমন একজন প্রতিনিধি হলেন সুকন্যা চক্রবর্তী, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

সানফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ সদস্য সুকন্যা বলেন, 'আমি আমার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী কমিউনিটিকে কীভাবে রিপ্রেজেন্ট করতে পারি, আমাদের ভয়েজটা যেন উঠে আসে সব জায়গাতে তা নিয়ে কাজ করে থাকি। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নিয়ে একটা ডিবেট চলছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কোনো দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না।'

শুধু যে রাজনীতি তা নয়, সেখানেও সভা, সমাবেশ, বিতর্ক, আন্দোলন হয়। তবে সেখানে রয়েছে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। ভোটের মাধ্যমে ছাত্র নেতা নির্বাচিত করেন শিক্ষার্থীরা। পাশের দেশ ভারতের জহুর লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এআইএসএফের সাধারণ সম্পাদক দিনেজ সিরানগারাজের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলে আসলেই কি শিক্ষার পরিবেশ সুন্দর হয় ?

১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয় ছাত্র সংগঠনগুলো। ছবি: এখন টিভি

দিনেজ বলেন, 'ছাত্ররাজনীতি গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাক্ষেত্র রাজনীতি ছাড়া অসম্পূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হতে শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা মানে পুরো দেশকে ধ্বংস করা।'

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অনেক দেশেরই রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কোরিয়ায় ছাত্র আন্দোলনে প্রাণহানিরও ঘটনা ঘটেছে। তবে কোথাও ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার মতো সিদ্ধান্ত আসেনি। এই বিষয়ে দেশের ছাত্র সংগঠনগুলোর দায় কতটুকু এবং সেটা এড়াতে তাদের ভূমিকা নিয়ে জিজ্ঞাসা ছিল তাদের কাছে। সংকট কাটিয়ে সুস্থ্যধারার রাজনীতির কথা বললেন তারা।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাগীব নাইম বলেন, 'পলিসি সংকট বা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নানা মাত্রিক যে সংকট তা উঠে আসবে। জাতীয় সংসদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী। তার মানে রাজনীতি আসলে রাজনৈতিকদের হাতে নেই। বরং ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গিয়েছে। এখন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ বা বন্ধ করলে তার ইমপ্যাক্ট তো ২০ বছর পরে সংসদের ওপর পড়বেই।'

জাতয়ীতাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল হাসান বলেন, 'আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, হাইকোর্টের রায়ের প্রতিও আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমরা সে শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বুয়েট ক্যাম্পাসে কী ধরনের রাজনীতি হবে তা বুয়েটের শিক্ষার্থীরাই সিদ্ধান্ত নেবে।'

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি খাদিমুল বাশার জয় বলেন, 'ভবিষ্যতে যেন আমরা জাতীয় রাজনীতিতেও সেবা করতে পারি। সেজন্য সারা বাংলাদেশের নেতাকর্মীকে সচল রাখতে একটি মানদণ্ড থাকতে হবে যে, আমরা ছাত্ররাজনীতিকে আরও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।'

ছাত্র রাজনীতির দিকগুলো নিয়ে এখন টিবির সাথে কথা বলছেন ইতিহাস গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান। ছবি: এখন টিভি

ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে ষড়যন্ত্রের আধার মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ছাত্ররাজনীতিকে অপ্রাসঙ্গিক করা মানেই দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ বেড়ে যাওয়া।

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান বলেন, 'ছাত্ররাজনীতিতে কিন্তু ক্ষতি হয় না। এটি আরও ছাত্রদের মননশীলতা, সৃজনশীলতাকে বৃদ্ধি করে। যারা প্রকাশ্য সংগঠন, তারা বুয়েটে রাজনীতি না করায় গোপন সংগঠনগুলোর উত্থান হয়। এবং তাদের এভাবে উত্থান আমাদের সমাজের জন্য অনেক ক্ষতিকরও হয়।'

রাজনৈতিক অধিকার হরণ নয় বরং অপরাধ দমন করে আগামীর নেতৃত্ব সৃষ্টিতে আরও সুযোগ বাড়ানোর আহ্বানও জানান এই গবেষক।

এসএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর