ফসলি মাঠে শত ক্লান্তি আর আক্ষেপ নিয়ে পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য কৃষকের আহার বুনন। মাঠ থেকে ফসল তোলে কতটা নিজের ভাগ্য জুটবে-হিসাবটা ঠিকভাবে কখনোই মেলানো হয় না তাদের। তবুও গোটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরলস এ প্রচেষ্টা তাদের।
বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার পাশ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে উত্তপ্ত দুপুরে হালচাষে মগ্ন মোসলেম উদ্দিন। কিন্তু শরীরটা যে সায় দিতে চায় না আর। কৃষিকাজের জন্য একজন মানুষের শরীরে যতটুকু শক্তির প্রয়োজন, সেখানে টান পড়ে যায় মোসলেম উদ্দিনের।
তিনি বলেন, 'আগের মতো এত শক্তি পাই না। তাই খাটতেও পারি না। প্রতিদিন মাছ-ভাত, ডিম বা দুধ খাওয়া দরকার।'
মানুষের ওজন, উচ্চতা এবং বয়সের পাশাপাশি তার পরিশ্রমের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট পরিমাণের পুষ্টির প্রয়োজন হয়। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন কৃষকের শরীর থেকে দৈনিক ৫০০ এর উপরে ক্যালরি পোড়ায়। সে হিসেবে অন্য যেকোন পেশার চাইতে কৃষকের পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু চাহিদার কতটুকু তারা পাচ্ছেন?
অপুষ্টির দুষ্টু চক্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেকারত্ব থেকে অর্থের অভাব। অর্থের অভাবে পূরণ করা যায় না মৌলিক চাহিদা। ফলে তৈরি হয় স্বাস্থ্যহীনতা। যার কারণে কমে যায় কর্মদক্ষতা। সেখান থেকে আসে মানসিক অবসাদগ্রস্থতা, তৈরি হয় অদক্ষ জনগোষ্ঠী। সেই অদক্ষ জনগোষ্ঠী থেকে আবার ঘুরে ফিরে তৈরি হয় বেকারত্ব এবং অর্থের অভাব।
পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী বলেন, 'একজনের শরীরে প্রতিনিয়ত ক্যালসিয়াম, প্রোটিনের ঘাটতি থাকতে পারে। যেকারণে তাদের শরীরে ব্যাথা হয়। মানসিক ও শারীরিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে দক্ষতা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে। এটা চক্রাকারে চলতে থাকবে। তাদের সন্তানদেরও এমনটা থাকবে।'
মূলত এ অপুষ্টির সমস্যার উদ্ভব হয় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা থেকে। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বুঝায়, কোন ব্যক্তির সারাবছরের তার চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাদ্যের প্রাপ্তি। কিন্তু যারা পুরো দেশের মানুষের খাবার যোগান দিচ্ছেন, তাদের খাদ্যের নিরাপত্তা কতটুকু? উত্তপ্ত রোদের নিচে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখছেন যারা। দিনশেষে কতটুকু খাদ্য জুটছে তাদের কপালে! এমনকি ফসলের মাঠে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করা কৃষকের ইফতারের সময় খাবার ফর্দ কী থাকে?
এক কৃষাণী বলেন, টাকা পয়সা নাই তাই ফলমূল কিনে খাইতে পারি না। মুড়ি, মুড়কি দিয়েই ইফতারি করি।
রোজা রেখেও ইফতারে পুষ্টিকর খাবার জোটে না কৃষক পরিবারের। ছবি: এখন টিভি
গতবছরের জুন মাসে দেশে প্রথমবারের মতো খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে জরিপ চালিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। গেল ডিসেম্বরে জরিপের সারাংশ প্রকাশ করা হলেও এ সপ্তাহে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। মাঠ পর্যায়ে ১ হাজার ৪৮৮টি প্রাথমিক নমুনা ইউনিটের আওতায় মোট ২৯ হাজার ৭৬০টি খানা থেকে সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে এ জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
সাক্ষাতকারে গত এক বছরের পরিস্থিতি নিয়ে ব্যক্তি ও খানা পর্যায়ে মোট ৮টি প্রশ্ন করা হয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন- টাকা বা সম্পদের অভাবে আপনি কি পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেননি? কিংবা মাত্র অল্প কয়েক ধরনের খাবার খেতে হয়েছিল? গত একবছরে কোন একবেলার খাবার কি না খেয়ে থাকতে হয়েছিল? কিংবা কখনো ক্ষুধা লাগার পরও খেতে পারেননি? অথবা অভাবের কারণে পুরোদিনই না খেয়ে থাকতে হয়েছিল!
এসব প্রশ্নের জবাবে উঠে আসে দেশের খাদ্য নিরাপত্তহীনতার চিত্র। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যেখানে আয়ের পরিমাণভেদে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার, দরিদ্রতম ৭০.৩৭ শতাংশ, দরিদ্রতর ২২.৯০ এবং মধ্যম দরিদ্র প্রায় ১৫ শতাংশ। যদিও ধনীরা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা থেকে প্রায় পুরোপুরি মুক্ত। এছাড়াও পেশার দিক থেকে সবচেয়ে কম খাদ্য নিরাপত্তহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো।
কিন্তু গোটা দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সে সমস্ত কৃষক এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা অন্যান্য পেশার তুলনায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জরিপের তথ্য বলছে, কৃষির উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর প্রায় ২৬.১৩ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অর্থাৎ প্রতি চারজনের মধ্যে একজনেরও বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, 'এ জরিপটি আমরা প্রথমবারের মতো করেছি। ভবিষ্যতে এটি আরও বড় আকারে করার পরিকল্পনা রয়েছে।'
জনমিতি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, 'কৃষক এবং তার পরিবারের সদস্যরা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকলে উৎপাদনশীলতা থেকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে উপকারিতা পাওয়ার কথা, তা হুমকির মুখে পড়বে।'
এক দশক আগেও জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ১৮.০১ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৩.৪২% থেকে কমে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩.৩৭ শতাংশ। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামগ্রিকভবে কৃষক ভালো না থাকলে ভালো থাকে না কৃষিখাত।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, 'কৃষক যদি অসুস্থ হয় তাহলে আমার কৃষি অসুস্থ হয়ে যাবো। যার কারণে আমরা দেখছি জিডিপিতে কৃষির অবদান ধারাবাহিকভাবে কমছে।'
সম্প্রতি জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি-ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনেও ওঠে আসে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার চিত্র। তাদের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশের ৪৩ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে খাবার কিনতে হয়েছে। আর মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ ছিল খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়।