খৎনা করাতে যেয়ে আয়ানের মৃত্যু মানতে পারছে না কেউ। তবে এই মৃত্যু বাবা-মায়েদের হৃদয়ে খৎনার বিষয়ে ভীতি বাড়ানোর পাশাপাশি অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সন্তানের খৎনার জন্য কার কাছে যেতে হবে? কি পদ্ধতিতে করাতে হবে খৎনা? আধুনিক চিকিৎসা রেখে আবারও কী হাজামের কাছে শরণাপন্ন হলে ভালো হবে? এখন এসব প্রশ্নই যেন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেক অভিভাবকের মনে।
নিরাপদ খৎনার ক্ষেত্রে বয়স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাবা মায়েরা আড়াই থেকে ৩ বছরের মধ্যে খৎনা সম্পন্ন করতে চাইলেও সর্বোত্তম সময় ৩ থেকে ৫ বছর বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, 'তিন বছরের আগে মুসলমানি করার পরামর্শ দেই না। যদি না তার খুব বেশি প্রয়োজন না হয়।'
অভিভাবকরা সামান্য অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার করে খৎনা করাতে নিরাপদ বোধ করলেও ৩/৪ বছরের কম বয়সী শিশুরা অবুঝ হওয়ায় সেটি সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মির্জা কামরুল জাহিদ বলেন, 'ব্যাথামুক্ত করার বিষয়টাই আমাদের কঠিন হয়ে যায়। আমরা চেষ্টা করি সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে করার। অনেক বাচ্চার খৎনা করতে নিয়ে গেছি কিন্তু করতে পারিনি। মা-বাবাই নামিয়ে নিয়ে গেছে।'
এই বাস্তবতায় চিকিৎসকদের হাতে সর্বোত্তম বিকল্প স্বল্প সময়ের জন্য অজ্ঞান করে খৎনা সম্পন্ন করা। অবুঝ শিশুদের জন্য এটিই বিজ্ঞানসম্মত নিরাপদ উপায় বলে মত সিংহভাগ বিশেষজ্ঞের।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের শিশু সার্জারির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আমিনুর রশিদ বলেন, 'তাতে একটা ইঞ্জেকশন দেই, তারপর ঘুমিয়ে গেলে পিছনের মেরুদণ্ডের নিচের দিকে আরেকটা ইনঞ্জেকশান দিলে ব্যাথামুক্ত হয়ে যায়। আধাঘণ্টার মধ্যে আমাদের কাজ শেষ।'
তবে শিশুকে অজ্ঞান করবার মাত্রা যেমনই হোক, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে চিকিৎসককে সব ধরনের বিকল্প পথ প্রস্তুত রাখার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।
অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. এ বি এম মাকসুদুল আলম বলেন, 'বাচ্চাকে যদি কাউন্সিলিং করা যায় আর সার্জন যদি দক্ষ হয় তাহলে কমিউনিকেট করতে পারে। অনেক সময় লোকালটা দিয়েও করা যেতে পারে। লোকাল দিয়ে করলেও বাতাস চলাচলের পথটা নিরাপদ রাখতে হয়।'
তবে বয়স ও ওজনের পার্থক্য অনুসারে শিশুকে অ্যানেসথেসিয়ার ডোজ দেয়ার প্রক্রিয়াটি তুলনামূলক জটিল। শিশুদের অজ্ঞান করার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক ছাড়া হরহামেশাই এই ভুল হয়ে যায় যেটি আয়ানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে বলে মত চিকিৎসকদের।
একটি দুটি দুর্ঘটনায় ভীত হয়ে হাজামের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিপদজনক বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। কারণ প্রতিটি শিশুকে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে খৎনা করা হয়।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'মুসলমানির সময় রক্তক্ষরণেও মানুষ মারা যেতে পারে। যদি তার হিমোফিলিয়া থাকে, সেজন্য মুসলমানি তার নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারটা তারা জানে না।'
বাংলাদেশে অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সংখ্যা তেইশোর কাছাকাছি। খৎনা ছাড়াও প্রতিদিন হাজারও শিশুর নানা ধরনের সার্জারি হলেও শিশুদের অজ্ঞান করার প্রশিক্ষিত ডাক্তারের সংখ্যা শ' খানেকের বেশি নয়।
লেজার পদ্ধতিতে খৎনা জনপ্রিয় হলেও সেটিতে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগের পদ্ধতি একই রকম। শিশুদের অভিজ্ঞ সার্জন ও অজ্ঞানের ডাক্তার ছাড়া এই পদ্ধতিতেও ঝুঁকি সমান বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
প্রতি বছর ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার অর্থাৎ দেশের সর্বোচ্চ খৎনা সম্পন্ন হয় বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে। সার্জারির পাশাপাশি শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ অজ্ঞানের ডাক্তার থাকায় এক যুগেও খৎনা করাতে যেয়ে দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। তাই খৎনার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতাল বেশি নিরাপদ বলে মতে বিশেষজ্ঞদের।