সিরাজগঞ্জের বেলকুচির চঁন্দনগাতী গ্রামের তাঁতি রইস উদ্দিন ও আলেয়া দম্পতির প্রথম সন্তানের নাম রোজিনা। যে বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে তার দিন কাটে ঘরের দুয়ারে শুয়ে থেকে।
জন্মের ৫ মাস পর মেয়ের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি বুঝতে পারেন তারা। ১২ বছর চিকিৎসার পাশাপাশি নানা চেষ্টার পরও সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে না পেরে দুশ্চিন্তায় বাবা-মায়ের।
রোজিনার বাবা বলেন, 'অনেক জায়গায় চিকিৎসার জন্য গেলেও তেমন ফল পাইনি। বর্তমানে মেয়ের দেখাশোনা করা খুব কষ্টকর হচ্ছে।'
শুধু রোজিনাই নয়, এমন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর সংখ্যা এই উপজেলায় বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। চঁন্দনগাতী ও গাড়ামাসি এলাকায় দেখা মেলে বেশ কয়েকজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে বেলকুচি উপজেলায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭৩৭ জন। যার সঙ্গে গেলো ৫ বছেরে যুক্ত হয়েছে আরও ৬ হাজার ১৮১ জন।
সরকারি তালিকাতেই ৫ বছরে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি? অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আশঙ্কাজনক তথ্য।
বেলকুচি উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার ঘোষ জানান, 'তাঁত কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য থেকে পরিবেশ দূষিত হওয়ায় এ অঞ্চলে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বেশি।'
বেলকুচি প্রেসক্লাব সভাপতি সাইদার রহমান বলেন, 'আবাসিক এলাকার ভেতরে বাড়ি ও তাঁত কারখানাগুলো করা। সেখান থেকে শব্দ দূষণ হচ্ছে। সাথে কাপড় ও সুতার ডায়িং এবং প্রসেসিং থেকে খাবার ও পানি দূষিত হচ্ছে।'
উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে উঠেছে সুতা প্রসেস মিল ও ডায়িং কারখানা। সরকারিভাবে এসব মিলের কোনও পরিসংখ্যানও নেই। এসব কারখানার কোনটাতেই বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা চোখে পড়ে না।
এলাকাবাসী বলেন, 'পুকুরের কোন মাছ বাঁচেনা, ময়লা ও মশা-মাছিতে দূষিত পানি। '
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য মিশছে এলাকার জলাধারে। কোথাও আবার রাতের আঁধারে বিষাক্ত বর্জ্য মোটর দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে পানির স্তরে। আর এ থেকেই মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে খাবার পানি।
স্থানীয়রা বলেন, পানির রঙ দেখেই পানি খাই না। পানি খেলে পেট ব্যাথা করে। রঙের পানির গন্ধে সবসময় জ্বর, ঠান্ডা-কাশি লেগেই থাকে। গলা জ্বালাপোড়া করে।'
সরকারি হিসেবে যেসব এলাকায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বেশি, সেখানকার খাওয়ার পানির নমুনা সংগ্রহ করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহায়তায় পরীক্ষা করা হয় জনস্বাস্থ্যের পরীক্ষাগারে। প্রতিবেদনেও আসে একই তথ্য। পানিতে মিলেছে বিভিন্ন রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি, যার মধ্যে আছে সীসাও।
সিরাজগঞ্জ সীমান্তবাজার ডিগ্রি কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অচিন্ত কুমার সুর রয় জানান, 'এই তরল বর্জ্য জলাশয়ে গিয়ে বৃষ্টি ও বন্যার পানির সঙ্গে মিশে পুরো এলাকার দূষণ ঘটায়।'
প্রতিবেদন নিয়ে কথা হয় শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. শর্মিলী পালের সঙ্গে।
তিনি জানান, 'গর্ভবতী নারীর রক্তে অতিরিক্ত সীসা মিশে গেলে অপরিণত শিশু জন্মের কারণ হতে পারে।'
এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির পরও কেন বন্ধ করা হচ্ছে না এসব কারখানা?
এমন প্রশ্নের উত্তরে সিরাজগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল গফুর জানান, 'প্রসেস মিলগুলোর তালিকা তৈরি হচ্ছে এবং বেশকিছু মিলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে।'
নোটিশের পরও কিভাবে চলছে এসব মিল? তা দেখতে কয়েকটি সুতা প্রসেস মিলে গেলে মালিকরা জানান, পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে জানলেও তাঁতের উপর যেহেতু এলাকার অর্থনীতি নির্ভরশীল তাই প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে সব। ইটিপি নির্মাণ ব্যয়বহুল ও স্থান সংকুলান না থাকায় সরকারের সহায়তা চান তারা।
বেলকুচি প্রসেস মিল অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি হাজী আব্দুল মজিদ বলেন, 'পরিবেশের ছাড়পত্র নিতে হলে আমাদের এক বছর পর্যন্ত ঘুরতে হয়। এ জন্য টাকাও খরচ করতে হয়। যা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তখন কিছু টাকা দিলে আর কিছু বলে না, আমরা এভাবে কাজ করি। এভাবেই চলছে।'
ডায়িং মালিক হাজী মো. কাইফুল ইসলাম বলেন, 'সরকার আমাদের একটা জায়গা করে দিলে আমরা সেখানে গিয়ে কারখানা ও বর্জ্য পরিশোধনাগার করবো।'
বেলকুচির অর্থনীতির পাশাপাশি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য যেন হুমকিতে না পড়ে এজন্য সমন্নিত উদ্যোগের কথা জানান জেলা প্রশাসক।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মীর মাহবুবুর রহমান জানান, 'মাঝেমাঝে অভিযান পরিচালনা করছি, পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধ করছি তারা যেন ইটিপি নির্মা ণ করে। এছাড়া তো স্থায়ী সমাধান নেই।'
প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে বেলকুচিতে এই অবস্থা চললেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।