সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যবিরোধী শক্তির অশুভ বিকাশরোধে সরকার নীরব কেন, প্রশ্ন টিআইবির

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) লোগো
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) লোগো | ছবি: এখন টিভি
1

দেশব্যাপী ধর্মীয় সহাবস্থান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যবিরোধী শক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশ, ধর্মান্ধতা ও সংখ্যাগুরুতান্ত্রিক অ সহিষ্ণুতার বিপজ্জনক বিস্তৃতির উদ্বেগজনক উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। মানিকগঞ্জে বাউল শিল্পী আবুল সরকারের গ্রেপ্তার এবং তার সমর্থকদের ওপর মানববন্ধন চলাকালে সংঘটিত সমন্বিত মব-হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে টিআইবি এ মন্তব্য করেছে। এসব অশুভ বিকাশরোধে সরকার নীরব কেন? প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে শিল্পীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হলেও, প্রকাশ্য দিবালোকে সংগঠিত হামলা থেকে আহত বাউল শিল্পীদের রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা ও এ প্রসঙ্গে সরকারের নীরবতা আইনের শাসন, মানবাধিকার, মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকারকে পদদলিত করেছে।

বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখানোর সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হওয়া অমূলক নয় যে এ ঘটনা একটি সুসংগঠিত কৌশলের অংশ। দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, লোকঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক অনুশীলন এবং সংখ্যালঘু বিশ্বাসের ওপর চাপ বিভিন্ন সময়ে সামনে এসেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, গত বছর কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর এ প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। স্থানীয়ভাবে ধর্মান্ধতানির্ভর আক্রমণাত্মক ব্যানারের পেছনে সক্রিয় শক্তিগুলো কার্যত ধর্মীয় বৈচিত্র্য, গোষ্ঠীগত ভিন্নমত, সাংস্কৃতিক বহুত্ব, লোকায়ত ও আধ্যাত্মিক বৈচিত্র্যকে দমন করার উগ্র মিশন চালাচ্ছে। কেন- এ প্রশ্নের যেমন জবাব পাওয়া যায়নি, তেমনি ধর্মান্ধ মহলের উগ্র চাপের মুখে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত কেন বাতিল করে এ ধরনের অপশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলো, তারও কোনো সদুত্তর নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, সরকারের নীরবতা এবং দুর্বল আইন প্রয়োগ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় তোষণ হিসেবে ব্যবহার করছে। এমতাবস্থায়, অবিলম্বে বাউলদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংবিধান অঙ্গীকারের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখতে আহ্বান জানাই আমরা।’

আরও পড়ুন:

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকায়ত সংস্কৃতি চর্চা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা বহুমুখী চাপে প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মানিকগঞ্জের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, হামলার মুহূর্তে পুলিশ দৃশ্যত অনাগ্রহী ও পর্যবেক্ষক ভূমিকায় অবস্থান করেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তোলে। প্রকাশ্য হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান অনীহা ও সরকারের নীরবতাকে গোষ্ঠীগত সহিংসতার একটি অনানুষ্ঠানিক অনুমোদন হিসেবে ব্যাখ্যা করার ঝুঁকি তৈরি করে।’

তিনি বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ—এ তারই ধারাবাহিকতায় অধিকতর উদ্বেগ তৈরি করছে। কিন্তু শুরু থেকেই সরকার এ সকল অপতৎপরতার প্রতিরোধে স্বচ্ছ অবস্থান বা ভূমিকা গ্রহণ করতে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে একদিকে ধর্মান্ধতা ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ ধর্ম চর্চা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও স্বাধীনতা হরণ হয়েছে। উগ্রতাকে রাষ্ট্রীয় তোষণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাষ্ট্রের দ্রুততম পদক্ষেপটি যখন একজন শিল্পীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, অথচ প্রকাশ্য সহিংসতার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র দৃঢ়তা অনুপস্থিত থাকে, তখন রাষ্ট্র আসলে কী বার্তা দেয়? সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের ওপর আক্রমণকারী শক্তির সামনে রাষ্ট্র ভীত, অপারগ না-কি পরিকল্পিতভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে এমন প্রশ্ন ওঠাও অমূলক নয়।’

তিনি বলেন, ‘ভিন্নমত, সংস্কৃতি বা বিশ্বাসের প্রতিনিয়ত অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, আক্রমণের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার কারণে একদিকে যেমন তা সামাজিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত হচ্ছে, অন্যদিকে রক্তক্ষয়ী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত “নতুন বাংলাদেশ”-এর মানবাধিকার, সংখ্যালঘু সুরক্ষা এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিও প্রতিনিয়ত পদদলিত হচ্ছে। মব-ভায়োলেন্স, ধর্মীয় উস্কানি এবং ভিন্নমত, সংস্কৃতি বা ধর্মীয় বিশ্বাস দমনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানাই।’

এসএস