পারিবারিক আদালতে কেন যাবেন, কখন যাবেন

পারিবারিক আদালতে কেন যাবেন, কখন যাবেন
পারিবারিক আদালতে কেন যাবেন, কখন যাবেন | ছবি : সংগৃহীত
0

দাম্পত্য জীবন কিংবা পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন যখন ব্যক্তিগত আলোচনার সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং আবেগ দিয়ে সমাধান সম্ভব হয় না, তখনই আইনগত হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে ওঠে। সন্তানের অভিভাবকত্ব, স্ত্রীর ভরণপোষণ (Maintenance) বা বিবাহবিচ্ছেদের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে আইনগত সমাধান (Legal Solution) পেতে একমাত্র ভরসা পারিবারিক আদালত (Family Court)। কিন্তু সাধারণ মানুষ প্রায়শই দ্বিধায় ভোগেন— ঠিক কোন পরিস্থিতিতে এবং কী কী আইনি অধিকার নিয়ে তারা এই আদালতের দ্বারস্থ হবেন? এই আদালত মূলত পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করে কীভাবে?

পারিবারিক বা দাম্পত্য জীবনে যখন কোনো বিরোধ বা কলহ (Family Dispute) দেখা দেয় এবং ব্যক্তিগত বা সামাজিক সালিশের মাধ্যমে কোনোভাবেই তার আইনগত নিষ্পত্তি (Legal Resolution) করা সম্ভব হয় না, তখনই চূড়ান্ত আশ্রয় হিসেবে পারিবারিক আদালতের (Family Court) দ্বারস্থ হওয়া উচিত। দেশে শুধুমাত্র পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যেই এই আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে মনে রাখা জরুরি, পারিবারিক আদালত সব ধরনের বিরোধের জন্য নয়; এটি কেবল পাঁচটি নির্দিষ্ট পারিবারিক সমস্যার সমাধান করে থাকে।

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সহকারী জজ আদালত (Assistant Judge Court) মূলত পারিবারিক আদালত হিসেবে গণ্য হয়। যদিও কিছু এলাকায় সহকারী জজ আদালতকে সুনির্দিষ্টভাবে 'পারিবারিক আদালত' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু এর এখতিয়ার (jurisdiction) একই থাকে। এই আদালত যে পাঁচটি প্রধান বিষয়ে মামলার নিষ্পত্তি করে:

  • বিবাহবিচ্ছেদ (Divorce)
  • দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার (Restitution of Conjugal Rights)
  • মোহরানা (Dower)
  • ভরণপোষণ (Maintenance)
  • সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত (Guardianship and Custody of Children)

আরও পড়ুন:

পারিবারিক আদালতের এখতিয়ারভুক্ত ৫টি প্রধান আইনি বিষয়

১. বিবাহবিচ্ছেদ (Divorce) :

বিবাহবিচ্ছেদের জন্য সব ক্ষেত্রে আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, তবে স্ত্রীর পক্ষে কিছু পরিস্থিতিতে আদালতে যাওয়া বাধ্যতামূলক:

  • স্ত্রীর পক্ষ থেকে আদালতের মাধ্যমে তালাক: যদি কাবিননামার ১৮ নম্বর ঘরে স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া না থাকে, কেবল সেই ক্ষেত্রেই স্ত্রী আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারেন।
  • খোলা (Khula) ও মোবারাত (Mubara'at) বিচ্ছেদ: যদি স্ত্রী স্বামীকে ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে বা পারস্পরিক সমঝোতায় রাজি করাতে পারেন, তাহলে আদালতের আশ্রয় ছাড়াই তা কার্যকর করা যায়। তবে স্বামী সম্মত না হলে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

২. দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার (Restitution of Conjugal Rights):

যখন স্বামী বা স্ত্রী কোনো বৈধ কারণ ছাড়া দাম্পত্য জীবন ব্যাহত করে সংসারে ফিরতে বা একসঙ্গে বসবাস করতে অস্বীকার করেন, তখন অন্য পক্ষ আইনি প্রতিকার চাইতে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন।

৩. দেনমোহর বা মোহরানা (Dower) :

স্বামীর নিকট থেকে পাওনা অপরিদত্ত দেনমোহরের (Unpaid Dower) জন্য স্ত্রী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। এই মামলার ক্ষেত্রে তামাদির মেয়াদ অত্যন্ত জরুরি:

  • তাৎক্ষণিক মোহরানা: যে তারিখে স্ত্রী দেনমোহরের টাকা দাবি করেন এবং স্বামী তা দিতে অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করেন, সেই তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে।
  • বিলম্বিত মোহরানা: বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হওয়ার বা স্বামীর মৃত্যুর তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।


৪. ভরণপোষণ (Maintenance):

স্বামী যদি আইনত বাধ্য থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর ভরণপোষণ (Maintenance) দিতে অস্বীকার করেন, তবে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে প্রাপ্য ভরণপোষণ দাবি করতে পারেন।

  • সময়সীমা: স্ত্রী যেদিন থেকে ভরণপোষণের টাকা দাবি করবেন, সেদিন থেকে তিন বছরের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করা বাধ্যতামূলক।


৫. সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত (Guardianship and Custody):

পিতা-মাতার মধ্যে বিচ্ছেদ বা অন্য কোনো কারণে সন্তানের অভিভাবকত্ব (Guardianship) এবং তার হেফাজত বা জিম্মা (Custody) নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে, সন্তানের সর্বোত্তম কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করা যায়। আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি প্রদান করেন।

হাইকোর্ট | ছবি: সংগৃহীত

পারিবারিক আদালতে মামলা দায়েরের পদ্ধতি ও আইনি বাধ্যবাধকতা

পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদালতে আশ্রয় নেওয়ার প্রক্রিয়াটি একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়।

১. মামলার এখতিয়ার ও স্থান (Jurisdiction and Filing Location) :

  • সাধারণ নিয়ম: যে পারিবারিক আদালতের স্থানীয় সীমার মধ্যে উভয় পক্ষ একসময় একসঙ্গে বসবাস করেছে বা সর্বশেষ বসবাস করেছে, অথবা যেখানে সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে, সেই আদালতে মামলা করতে হবে।
  • স্ত্রীর বিশেষ সুবিধা: বিবাহবিচ্ছেদ, মোহরানা এবং ভরণপোষণের মতো ক্ষেত্রে স্ত্রী বর্তমানে যেখানে বসবাস করেন, সেই এলাকার আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য মামলা দায়ের করতে পারেন।
  • আর্থিক সীমা: দেনমোহর বা ভরণপোষণের পরিমাণ যতই হোক না কেন, তা নিয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা করা যাবে।

২. আবেদন ও কোর্ট ফি (Filing and Court Fees)

  • আবেদন প্রক্রিয়া: পারিবারিক আদালতে আইন চর্চা করেন এমন একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আবেদন করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা যারা পারিবারিক বিষয়ে কাজ করে, তাদের আইনজীবীর মাধ্যমেও মামলা দায়ের করা সম্ভব।
  • কোর্ট ফি: পারিবারিক আদালতে আশ্রয় নিতে হলে খুব বেশি কোর্ট ফি (আদালত ফি) দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, যা সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়ী।


৩. শুনানির প্রক্রিয়া ও আপিলের বিধান (Hearing and Appeal Rules)

  • হাজিরার নির্দেশ: কোনো আবেদন পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আদালত বাদী ও বিবাদীকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেবেন। আদালত প্রয়োজনে রুদ্ধদ্বার কক্ষেও (Closed-door) বিচারের ব্যবস্থা করতে পারেন।
  • আপিল সীমাবদ্ধতা: পারিবারিক আদালতের ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিলের বিধান থাকলেও দুটি ক্ষেত্রে আপিল করা যাবে না:

বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি-এর বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না।

পাঁচ হাজার টাকার কম মোহরানার ডিক্রি-এর বিরুদ্ধে আপিল চলবে না।


আপস মীমাংসার সুযোগ: পারিবারিক আদালতের প্রধান সুবিধা

পারিবারিক আদালতের (Family Court) অন্যতম প্রধান এবং সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে পক্ষগুলোর মধ্যে আপস মীমাংসার (Compromise/Conciliation) মাধ্যমে দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যাওয়ার আগেই পক্ষগুলোকে একটি সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছাতে সহায়তা করে।

বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে আপসের সুযোগ

পারিবারিক আদালতে মামলার বিচার চলাকালীন আপস মীমাংসার সুযোগ থাকে দুই দফায়:

  • প্রথম দফা: মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আগে আদালত একবার আপসের সুযোগ দেন।
  • দ্বিতীয় দফা: পরবর্তী সময়ে মামলার রায় ঘোষণার ঠিক আগেও আদালত আপসের জন্য দ্বিতীয় দফায় সুযোগ প্রদান করেন।

যদি উভয় পক্ষ আপসে সম্মত হয়, তবে সেই আপসমূলের ভিত্তিতেই আদালত ডিক্রি প্রদান করার সুযোগ রাখেন। পারিবারিক বিষয়ে আদালতে মামলা দায়ের হলেও, নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে বিরোধ নিষ্পত্তি করে নেওয়াই সবসময় সর্বোত্তম উপায়।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট |ছবি: সংগৃহীত

পারিবারিক আদালত কী, মামলার ধরন, মামলা করার প্রদ্ধতি নিয়ে কিছু প্রশ্নোত্তর-FAQ

প্রশ্ন: পারিবারিক আদালত কোন ধরনের মামলা মোকাবেলা করে?

উত্তর: পারিবারিক আদালত নিম্নলিখিত ধরণের মামলাগুলি নিয়ে কাজ করে:

  • দত্তক
  • শিশুদের জন্য হেফাজত এবং পরিদর্শন
  • গার্হস্থ্য সহিংসতা / সুরক্ষার আদেশ
  • পালক যত্ন অনুমোদন এবং পর্যালোচনা
  • অভিভাবকত্ব
  • কিশোরী কর্তব্যে অবহেলা
  • পিতৃত্ব
  • তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন ব্যক্তি (পিন)
  • শিশু এবং/অথবা স্বামী-স্ত্রী সহায়তা

প্রশ্ন: পারিবারিক আইন সম্পর্কিত আদালতের ফাইলগুলি কি গোপনীয়?

উত্তর: পারিবারিক আদালতের ফাইল এবং সুপ্রিম কোর্টের বিবাহ সংক্রান্ত ফাইলগুলি গোপনীয়। শুধুমাত্র পক্ষ, তাদের অ্যাটর্নি, বা একটি পক্ষ দ্বারা স্বাক্ষরিত লিখিত অনুমোদন সহ কেউ তাদের অ্যাক্সেস করতে পারে।

প্রশ্ন: আমি গার্হস্থ্য সহিংসতা থেকে বেঁচে আছি, পারিবারিক আদালত কীভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারে?

উত্তর: গার্হস্থ্য সহিংসতা থেকে বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা পারিবারিক আদালত থেকে সুরক্ষার আদেশ পেতে পারেন।

প্রশ্ন: আমি কি পারিবারিক আদালতে একজন অ্যাটর্নি পাওয়ার অধিকারী?

উত্তর: যদিও পারিবারিক আদালতের প্রক্রিয়াটি এমন লোকদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে যাদের আইনজীবী নেই, এটি একজন আইনজীবী থাকা সহায়ক হতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হেফাজত সংক্রান্ত বিষয় এবং পারিবারিক আদালতে সুরক্ষা মামলার আদেশ সহ কিছু কার্যধারায় জড়িত ব্যক্তিরা একজন অ্যাটর্নি পাওয়ার অধিকারী।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে সাধারণত কোন আদালতকে পারিবারিক আদালত (Family Court) হিসেবে গণ্য করা হয়?

উত্তর: প্রতিটি জেলায় সহকারী জজ আদালত (Assistant Judge Court) পারিবারিক আদালত হিসেবে গণ্য হয় এবং পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা রাখে।

প্রশ্ন: স্বামী কর্তৃক তালাক কার্যকর করার ক্ষেত্রে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ধারা ৭ অনুযায়ী দুটি বাধ্যতামূলক শর্ত কী কী?

উত্তর: স্বামীকে অবশ্যই তালাক ঘোষণার সাথে সাথে চেয়ারম্যানকে লিখিত নোটিশ দিতে হবে এবং তালাকটি চেয়ারম্যানের নিকট নোটিশ প্রদানের তারিখ থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর কার্যকর হবে (যদি সালিশী পরিষদে আপস ব্যর্থ হয়)।

প্রশ্ন: দেনমোহর আদায়ের মামলা করার জন্য তামাদির মেয়াদ কতদিন?

উত্তর: তাৎক্ষণিক মোহরানার ক্ষেত্রে, স্ত্রী যখন দেনমোহর দাবি করেন এবং স্বামী তা অস্বীকার করেন, সেই তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। বিলম্বিত মোহরানার ক্ষেত্রে, বিচ্ছেদ কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে।

প্রশ্ন: স্ত্রী কোন পরিস্থিতিতে আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে বাধ্য হন?

উত্তর: স্ত্রী যখন কাবিননামার ১৮ নম্বর ঘরে তালাক প্রদানের ক্ষমতা পান না, কেবল সেই ক্ষেত্রেই স্ত্রীকে আদালতে মামলা দায়ের করে বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে হয়।

প্রশ্ন: পারিবারিক আদালতে বাড়ছে মামলা দায়েরের ফি?

উত্তর: পারিবারিক আদালতে মামলা দায়েরের ফি ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়েছে, যা পারিবারিক আদালত আইন-২০২২ এর খসড়া অনুমোদনের পর কার্যকর হয়। এই পরিবর্তনটি মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমাতে এবং জেলা জজের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এসআর