জীবনযাপন , ইউরোপ
বিদেশে এখন
0

বাংলা ভাষা, খাবার-চালচলনে বিশেষভাবে লক্ষণীয় পর্তুগিজদের ছাপ!

ইউরোপীয়দের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম পদাঙ্ক আঁকেন পর্তুগিজরা। এই ঘটনার ৫২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও বাংলা ভাষা, খাবার ও চালচলনে বিশেষভাবে লক্ষণীয় পর্তুগিজদের ছাপ। এখনও বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে পর্তুগিজদের নানা ঐতিহাসিক চিহ্ন।

পর্তুগালের সুপার মার্কেটে দেখা মেলে বাংলাদেশের বিখ্যাত ফল আনারস যেটিকে পর্তুগিজরা আনানাস নামে চেনে। এছাড়াও পাউ, পেয়ারার মতো শব্দগুলো সরাসরি পর্তুগিজ ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। যার মূলে রয়েছে পর্তুগিজদের ভারতবর্ষে পদার্পন।

বাণিজ্যের লক্ষ্যে মধ্যযুগে ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রথম বাংলায় আগমন করেন পর্তুগিজরা। কয়েক শতাব্দি উপমহাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করে পর্তুগিজ বণিকরা। এতে বাংলা ভাষায় যুক্ত হওয়া পর্তুগিজ শব্দের সংখ্যা ছাড়িয়েছে এক হাজারেরও বেশি।

বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচয়িতা ম্যানুয়েল দ্যা আসুম্পসাও ছিলেন পর্তুগিজ ধর্মযাজক। ভোকাবোলারিও এম ইডিওমা বাংলা ব্যাকরণ বইটি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে বই আকারে ছাপা হয় ১৭৪৩ সালে। বাংলা ভাষার প্রথম বই হিসেবে একে উল্লেখ করেন বহু ভাষাবিদ । প্রথম বাংলা অভিধান ও ব্যাকরণের মতোই আজও বাংলা ভাষার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে পর্তুগিজ ভাষা।

শুধু ভাষাই নয়, খাবার ও আচার-আচরণসহ দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রে শতাব্দি পেরিয়েও তাই বাংলার মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় পর্তুগিজদের ছাপ। বাংলাদেশ ও পর্তুগালের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নিয়ে দেশটির বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন পর্তুগিজ গবেষকেরা।

পর্তুগালের নোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ বিষয়ক গবেষক ও সহকারি অধ্যাপক জোয়াও মাপ্রিল বলেন, 'প্রথম বাংলা ব্যাকরণের রচয়িতা ম্যানুয়েল দ্যা আসুম্পসাও। বাংলাদেশের স্থাপনাতেও পর্তুগিজ শিল্পের ছাপ রয়েছে। এখনও ঢাকা, বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের স্মৃতিস্তম্ভ, সমাধিসৌধ ও গির্জায় পর্তুগিজদের উপস্থিতি খুঁজে পাবেন।'

পর্তুগাল-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রানা তাসলিম উদ্দিন বলেন, 'তারা(পর্তুগিজরা) প্রায় ১৫০ বছর বাংলাদেশে অবস্থান করেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। সেসময় তারা শুধু ব্যবসা-বানিজ্যই করেননি। তাদের সেখানে কৃষ্টি-কালচার এবং বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, খাবার তারা রেখে এসেছেন।'

ইউরোপীয় জাতির বেশিরভাগই যখন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের নৌরুট আবিষ্কারে ব্যর্থ, তখন সফলতা আসে বিখ্যাত পর্তুগিজ নাবিক ভাসকো দা গামার হাত ধরে। তবে, তার জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন পর্তুগিজ রাজ পরিবারের সন্তান প্রিন্স হেনরি দ্য নেভিগেটর। নৌ রুটে ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে রাজধানী লিসবনে ১৪১৯ সালে নাবিকদের প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যেখান থেকে দীক্ষা নেয়া নাবিকরাই ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে পতুর্গালকে পরিচিত করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নৌ-শক্তি হিসেবে।

মনুমেন্ট অব দ্যা ডিসকভারিস কিংবা আবিষ্কারের স্মৃতিস্তম্ভ পর্তুগালের সমুদ্রজয়ী নাবিকদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এই জায়গাটি থেকেই পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই স্মৃতিস্তম্ভে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রিন্স হেনরি, ভাস্কো দ্য গামাসহ পর্তুগিজ সমুদ্রজয়ী নায়করা।

বসবাসের সময় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাংলায় নতুন শস্য আমদানি করে পর্তুগিজরা। একসময় সেগুলো দিয়েই আরম্ভ হয় কৃষিকাজ। বাংলাদেশি খাবারের বৈচিত্রে কারি ও রসগোল্লা ছাড়াও পর্তুগিজরাই প্রথম বাঙালিদের মাঝে আলুকে পরিচয় করিয়ে দেয় শস্য হিসেবে। শস্যের পাশাপাশি উপমহাদেশে আনা হয় ৩৫ রকমের গাছ। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বাদাম, ব্রাজিল থেকে আনারস, আফ্রিকা ও মোজাম্বিক থেকে আতাফল এবং ব্রাজিল থেকে আনা আলু ছিল এদের মধ্যে অন্যতম।

কালের পরিক্রমায় এখন পর্তুগালে প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশির বসবাস। দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের চালচলনে পর্তুগিজদের সঙ্গে মিল খুঁজে পান স্থানীয়রা।

পর্তুগিজ গবেষক সিসিলিয়া মেন্ডনি লুইস বলেন, 'খাদ্য, পোশাক এমনকি ভাষাতেও দুই দেশের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। এগুলো বাংলাদেশিদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে।'

চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজার, ক্যাথলিক চার্চ, বরিশালের পুরাতন পর্তুগিজ স্থাপনা ও কবর এখনও পর্তুগিজদের বাংলায় পদার্পনের সাক্ষী হয়ে আছে। যদিও নিদর্শনগুলো ধরে রাখতে নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ। পর্তুগিজদের সঙ্গে বাঙালির প্রায় ৫৫০ বছর পুরনো সংযোগের চিহ্ন সংরক্ষণ করতে তাই যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান সংশ্লিষ্টদের।

tech