জান্তার অব্যবস্থাপনায় সংকটে মিয়ানমার, সহায়তা চায় জাতিসংঘ

এশিয়া
বিদেশে এখন
0

মিয়ানমারে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়ালেও জান্তা সরকারের অব্যবস্থাপনা ও উদ্ধারকাজে ধীরগতি সংকটের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। প্রয়োজনীয় খাদ্য, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে শিশুরা রয়েছে মৃত্যুঝুঁকিতে, শঙ্কা ইউনিসেফের। এমন পরিস্থিতিতে সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জাতিসংঘের।

গত ২৮ মার্চ আঘাত হানা ৭.৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর সময় যতোই গড়াচ্ছে ততই সামনে আসছে মিয়ানমারের ভয়াবহ সংকটের চিত্র। অং সান সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ২০২১ সাল থেকে জান্তা সরকারের শাসন ব্যবস্থা ও অব্যাহত গৃহযুদ্ধের মধ্যে ভূমিকম্পের তাণ্ডব যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে মিয়ানমারে।

ধ্বংসস্তূপের নগরীতে রূপ নেয়া রাজধানী নেইপিদো ছাড়াও মান্দালে এবং সাগাইং অঞ্চলের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। অনেক হাসপাতালে যেমন রোগী ভর্তির জায়গা নেই, তেমনি বড় বড় হাসপাতালগুলোতে ফাঁটল দেখা দেয়ায় আহত এবং অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে উঠেছে।

এখানেই শেষ নয়, শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে বাস্তুচ্যুত হওয়া ধনী-গরিব বাসিন্দারা আজ এক কাতারে। একমুঠো খাবারের জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষকে। তালিকায় আছে বহু নারী শিশু।

পরিসংখ্যান তথ্য বলছে, ভূমিকম্পের আগেই মিয়ানমারে জরুরি মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন ছিল এক কোটি ৪ লাখ নারী এবং ৬০ লাখ শিশুর। এবার ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত বিভিন্ন নগরীতে নারী ও শিশুরা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়ায় চরমে পৌঁছেছে সংকটের মাত্রা। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে গর্ভবতী নারী ও সদ্য সন্তান জন্ম দেয়া মায়েরা।

স্থানীয় একজন বলেন, 'আপাতত আমরা মাটিতে ঘুমাই। কিছু মানুষ মশারি টাঙাতে পাড়ছে। অনেকে খোলা আকাশের নিচে নির্ঘুম। বিশেষ করে নারীদের অনেক বেশি প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সময় কাটাতে হচ্ছে।'

জীবন রক্ষাকারী টিকা থেকে শুরু করে খাদ্য, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে শিশুদের মৃত্যু ঝুঁকির শঙ্কা ইউনিসেফের।

ইউনিসেফের পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অ্যাডভোকেসি এবং যোগাযোগ প্রধান এলিয়ান লুথি বলেন, 'হ্যাঁ, শিশুদের মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। যদি আমরা পর্যাপ্ত সুপেয়ে পানি, চিকিৎসা সরবরাহ না পাই অপুষ্টির ঝুঁকি বাড়বে। এতে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও অনেক।'

চরম মানবিক সংকটে পিষ্ট অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে মিয়ানমার যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকারী দল ও দাতব্য সংস্থাগুলোর স্বেচ্ছাসেবকরা। পৌঁছে দেয়া হচ্ছে খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা সামগ্রী। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই সামান্য। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমার চরম ধ্বংসযজ্ঞ ও হতাশার কেন্দ্রবিন্দু উল্লেখ করে, দেশটির সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহায়তা তহবিল বাড়ানোর আহ্বান জানালেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

তিনি বলেন, 'ভূমিকম্প দেশটির দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ওপর বর্ষাকাল আসন্ন। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমার আবেদন, আপনারা অবিলম্বে প্রয়োজনীয় তহবিল বৃদ্ধি করুন। যাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যাদের, তাদের কাছে যেন দ্রুত সহায়তা পৌঁছায়।'

এদিকে ভূমিকম্পের এক সপ্তাহ পর এখনও নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছেন প্রিয়জনরা। ওই দিনের ভূমিকম্পে সেতুটি ভেঙে নদীতে পড়ে যাওয়া কন্যাকে খুঁজছেন এই বাবা। কন্যার সঙ্গে তিনিও পড়েছিলেন নদীতে, কিন্তু নিজে বেঁচে ফিরলেও, আদরের সন্তানকে না পাওয়ার বেদনা তাড়া করে ফিরছে এখনও।

স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, 'এখানে কোনো উদ্ধার অভিযান চলছে না। আমাকে নিজেই অনুসন্ধানের জন্য ডুবুরি ভাড়া করতে হচ্ছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানের জন্য ৫০ ডলারের কথা হয়েছে। মৃতদেহ খুঁজে পেলে তাদের ২০০ ডলার দেবো।'

ভূমিকম্পের দিনটি শুক্রবার হওয়ায় ওইদিন, জুম্মার নামাজের জন্য মসজিদে জড়ো হচ্ছিলেন মুসল্লিরা। তাই মান্দালেসহ বিভিন্ন শহরের ৫০টিরও বেশি মসজিদ ধসে প্রাণ গেছে বহু মানুষের। বেশ কয়েকজন অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরার পর তুলে ধরেছেন সেদিনের দুঃসহ সেই মুহূর্তের কথা।

ভূমিকম্প থেকে বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বলেন, 'আমি মসজিদের ভিতরে নামাজ পড়ছিলাম। ছাদ আমাদের ওপর ধসে পড়ে এবং আমরা সবাই ভেতরে আটকা পড়ি। তবে মসজিদের প্রবেশপথে থাকায় বেঁচে যাই। যারা ভেতরে ছিলেন তাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন।'

শুধু মসজিদ নয়, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় এবং ভিক্ষুদের অনেক আশ্রয়স্থলও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের সময় সতর্কতা অবলম্বনের কারণে অনেক প্রাণহানির মধ্যেও, নিজেকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন মান্দালের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু।

তিনি বলেন, 'প্রথম ভূমিকম্প অনুভব করার সাথে সাথেই আমি আমার বিছানার নিচে লুটিয়ে পড়ি। সমস্ত ধ্বংসাবশেষ বিছানার উপর পড়ায় আমি প্রাণে বেঁচে যাই। কিন্তু তখন ভয় পেয়ে দৌড় দেয়ায়, বিধ্বস্ত অবকাঠামোর আঘাতে অনেকের মৃত্যু হয়।'

সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ওঠে এসেছে জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের কথাও। জানা, গেছে, ভূমিকম্পের দিন নেইপিদোতে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন তিনি। ভবন কেঁপে উঠতেই, ভয়ে অনেকটা সময় নিজের টেবিল আঁকড়ে ধরে ছিলেন তিনি। পরে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীর পরামর্শে বাইরে বের হয়ে প্রায় এক ঘণ্টা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

এসএস