২০২০ সালের জুনে ভারতের সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ চুক্তি এককভাবে পায় ভারতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ সংস্থাকে আট গিগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি হলেও স্থানীয় বিদ্যুৎ পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ওই দামে সম্মত না হওয়ায় আটকে যায় চুক্তিটি। স্থানীয় কর্মকর্তাদের সে সময় বড় অঙ্কের ঘুষের প্রস্তাব দিয়ে চুক্তি ভেস্তে যাওয়া আটকায় আদানি গ্রুপ। ঘুষের অঙ্কটি ২৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় যা ২২শ' কোটি রুপির বেশি।
প্রকল্প নির্মাণে গেলো চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের তহবিল সংগ্রহ করেছে আদানি গ্রুপ। লেনদেনের শুরু ২০২১ সালে। এমন সময়েই ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের বড় অঙ্কের ঘুষ দেয়ার আশ্বাসে টনক নড়ে মার্কিন বিচার বিভাগ ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের।
এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ তদন্তের পর গেলো বুধবার ৫৪ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে নাম প্রকাশ করা হয় গৌতম আদানিসহ কমপক্ষে আটজনের। ভারত সরকারের ঘনিষ্ঠ হলেও আদানি ইস্যুতে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্কে পরিবর্তন আসবে না বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
হোয়াইট হাউজ প্রেস সেক্রেটারি ক্যারিন জ্যঁ-পিয়েরে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বন্ধুত্বের ভিত অত্যন্ত শক্ত বলে আমরা বিশ্বাস করি। দুই দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিটি বিষয়ে সহযোগিতার সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কূটনীতি। তাই আমরা আত্মবিশ্বাসী যে এই বিষয়টি এবং সামনের দিনের সকল সংকট মোকাবিলায় সফল হবো আমরা।’
চুক্তি বাস্তবায়ন হলে জ্বালানি খাত থেকেই আগামী ২০ বছরে ২শ' কোটি ডলার লাভ হতো ভারতের অন্যতম শীর্ষ শিল্প সংস্থা আদানি গ্রুপের। যুক্তরাষ্ট্রে মামলার জেরে এই চুক্তি তো হুমকির মুখে পড়েছেই, অন্যান্য দেশেও তোপের মুখে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি। কেনিয়ায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দ্বিতীয় রানওয়ে নির্মাণ ও যাত্রী টার্মিনাল সংস্কারে আদানির সাথে প্রস্তাবিত ৩০ বছর মেয়াদি ৭৪ কোটি ডলারের চুক্তিটিও বাতিল করেছে দেশটির প্রেসিডেন্ট। অস্ট্রেলিয়ায় আদানি গ্রুপের কয়লা বিভাগের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করেছে আদিবাসীরা।
অস্ট্রেলিয়ার নাগানা ইয়ারবাইন সিনিয়র কালচারাল কাস্টোডিয়ান অ্যাড্রিয়ান বুররাগুববা বলেন, ‘আমরা চাই তারা আমাদের হয়রানি বন্ধ করুক। আমার পরিবারকে হয়রানি করা বন্ধ করুক। জাতিবিদ্বেষী প্রচার থেকে সরে দাঁড়াক। বর্ণবাদে উসকানি দেয়া বন্ধ করুক। যত ক্ষতি আর যতভাবে আঘাত করেছে আমাদের, সবকিছুর জন্য তাদের প্রকাশ্যে ক্ষমাও চাইতে হবে।’
কেনিয়া প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো বলেন, ‘মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সড়ক ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সকল সংস্থাকে চলমান প্রকল্প প্রদান প্রক্রিয়া বাতিলে নির্দেশ দিয়েছি আমি।’
আদালতের নথি বলছে, গৌতম আদানি ও তার ভাগনে সাগর আদানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পরোয়ানা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছেন মার্কিন আইনজীবীরা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নয়, মূল অভিযুক্ত গৌতম আদানি নিজ দেশ ভারতেই অবস্থান করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ক্ষমতাসীন বিজেপির ঘনিষ্ঠ বলে এ নিয়ে বিব্রত ভারত সরকার। বিষয়টি আগামী সপ্তাহে পার্লামেন্টে তোলা হবে বলে জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস।
ভারতের বিজেপি নেতা সম্বিত পাত্র বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি এবং তাদের বিরুদ্ধে গঠিত অভিযোগের বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। তারা নিজেরাই নিজেদের স্বপক্ষে যুক্তি দেবে, বিবৃতি প্রকাশ করবে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।’
ভারতের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, ‘বিজেপির পুরো আর্থিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে আদানি। তাই প্রধানমন্ত্রী চাইলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। একভাবে পুরো দেশকে জিম্মি করেছে রেখেছে আদানি, তার মুঠোয় বন্দি ভারত।’
আদানির কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশে দ্বিধাবিভক্ত ভারতীয় গণমাধ্যম, বলছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। ফোর্বসের তালিকায় বিশ্বের ২২তম এবং ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় সাত হাজার কোটি ডলার। ঘুষ কেলেঙ্কারির জেরে পুঁজিবাজারে দুদিনে ২৮ শতাংশ দরপতন দেখেছে আদানি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনিয়োগও হারাতে পারেন এ ধনকুবের।