মঙ্গলবার বিকালের হামলার অবিশ্বাস্য পরিধি আর ধরনে হতবাক লেবাননের সাধারণ মানুষ। অন্য সব স্বাভাবিক দিনের মতোই চলছিল সব, ধারণাও ছিল না কারও- ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে। হঠাৎই শুরু একেকজনের কোমর পকেটে একের পর বিস্ফোরণ, বাজারে-রাস্তায়-দোকানে যে যেখানে ছিলেন, একজন একজন করে লুটিয়ে পড়তে শুরু করেন। কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই চতুর্দিকে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ, চিকিৎসা আর রক্তের অপেক্ষায় হাজার হাজার মানুষ।
লেবানন সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, দেশটির সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহ'র সদস্যদের ব্যবহৃত হাতে ধরা ছোট্ট যন্ত্র পেজারে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের জেরে এমন পরিস্থিতি। তারবিহীন টেলিযোগাযোগ ডিভাইস পেজার বিস্ফোরণে রাজধানী বৈরুতসহ সারা দেশে হিজবুল্লাহ আইনপ্রণেতার ছেলেসহ প্রাণ গেছে অনেকের, আহত ইরানি রাষ্ট্রদূতসহ প্রায় তিন হাজার মানুষ; আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন ২শ'র বেশি।
লেবানন হুসেইন হিজবুল্লাহ আইনপ্রণেতা হাজ হাসান বলেন, 'এই জঘন্য অপরাধের জবাব দিতেই হবে। যেভাবে এ হামলা হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল শত্রুদের এবং সম্ভবত লেবানন পর্যন্ত যুদ্ধ সম্প্রসারণের পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন চলছে।'
একে ইতিহাসের চরমতম নিরাপত্তা লঙ্ঘন আখ্যায়িত করে প্রতিবেশী ইসরাইলকে কঠোর শাস্তি দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে হিজবুল্লাহ। ইসরাইল এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া হামলাকারী দেশের সাধারণ মানুষের।
স্থানীয় জনগণের মধ্যে একজন জানান, ওদের পেশীশক্তির বিপরীতে আমরা মস্তিষ্ক ব্যবহার করছি। আমি মনে করি, জয় ইসরাইলেরই হবে।
যত দ্রুত সম্ভব বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান আরও এক ইসরাইলি। বলেন, 'ব্যক্তিগতভাবে আমি ভীত। এ ধরনের হামলায় তাদের ফিরে আসা আরও পেছাবে।'
গেল অক্টোবরে গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন শুরুর পর থেকে লেবানন সীমান্তে প্রতিদিনই ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ'র সঙ্গেও সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। সবমিলিয়ে কয়েক দশকের জটিলতম রূপ নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য সংকট। এ ঘটনায় কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতম মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, 'আমি এটা বলতে পারি যে এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। আগে থেকে আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। এই মুহূর্তে তথ্য সংগ্রহ করছি।'
যুক্তরাষ্ট্র হোয়াইট হাউজ প্রেস সেক্রেটারি ক্যারিন জ্যঁ-পিয়েরে জানান, ইসরাইল-হিজবুল্লাহ দ্বন্দ্ব যথেষ্ঠ দীর্ঘায়িত হয়েছে। প্রত্যেকের স্বার্থে যতো দ্রুত সম্ভব, এ সমস্যার সমাধান প্রয়োজন এবং তাও কূটনৈতিকভাবে।
মোবাইল ফোন হ্যাক ও ট্র্যাক এড়াতে নিরাপদ যোগাযোগের জন্য পেজারের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল হিজবুল্লাহ। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তাইওয়ান থেকে আমদানিকৃত পেজারের মাইক্রোফোনে বিস্ফোরক যুক্ত করে একে অস্ত্রে পরিণত করে ইসরাইলি গোয়েন্দারা। ব্যবহারকারীদের হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর পর কোনো এক সময় একযোগে বিস্ফোরিত হয় পেজারের ব্যাটারি।
যুক্তরাষ্ট্র সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জোসেফ স্টেইনবার্গ বলেন, 'পেজারের ভেতরে থাকা লিথিয়ামের ব্যাটারি বিস্ফোরণযোগ্য। কিন্তু একসাথে এতো পেজারে বিস্ফোরণ ঘটানো কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়।'এ অঞ্চলে এ ধরনের হামলা আমরা আগে কখনো দেখিনি। ইসরাইলের দিকে বন্দুক চালানো আর ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া তিন হাজার হাত এক সাথে অচল করে দেয়া বিশাল অর্জন। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের অপ্রতিরোধ্য গোয়েন্দা অনুপ্রবেশ সক্ষমতার উদাহরণ বলেও জানান ইসরাইল নিরাপত্তা থিংক ট্যাঙ্ক আলমা প্রতিষ্ঠাতা সারিত জেহাভি।
একযোগে পেজার বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা আগে ইসরাইলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা বলেছিল, দেশের উত্তরে হিজবুল্লাহ'র হামলা ঠেকিয়ে বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের নিরাপদে এলাকায় ফেরানো যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য।
এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছে ইরান, উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ।
এদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, প্রতিবেশী সিরিয়াতেও পেজার বিস্ফোরণে অন্তত ১৪ জন আহত হয়েছে। গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের দমনে সরকারি বাহিনীকে সহযোগিতা করছে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা।