ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্য রাজস্থানে ২০১৯ সালে ২৫ আসনের সবগুলোতে জয় নিশ্চিত করা বিজেপি গেলো ডিসেম্বরের বিধানসভা নির্বাচনেও রাজ্যটিতে জয়ী হয়। ছয় মাস না যেতেই এবারের লোকসভা নির্বাচনে দলটির আসনসংখ্যা নেমে এসেছে ১৪টিতে। প্রথমবারের মতো এ রাজ্যের আসন পেয়েছে বামপন্থি সিপিএম। দলটির হয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে ঠেকিয়ে দিয়েছেন যিনি, তিনি কৃষক নেতা আমরামাম।
নির্বাচনের ফলে কৃষকদের ক্ষোভের প্রভাব স্পষ্ট বলে উঠে আসছে ফল পরবর্তী প্রাথমিক বিশ্লেষণে। এই যেমন ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিনির্ভর রাজস্থানে ১১টি লোকসভা আসন হারিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। ভারতের রুটির ঝুড়ি বলে পরিচিত হরিয়ানায় ২০১৯ এর নির্বাচনে লোকসভার ১০ আসনের সবগুলোতে বিজেপি জিতলেও এবার তাদের আসনসংখ্যা নেমেছে পাঁচে, বাকি পাঁচটি জিতেছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস।
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশেও কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত ৬৫ শতাংশ মানুষ। রাজ্যের ৮০ আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছে মাত্র ৩৩টিতে, যা ২০১৯ এ ছিল ৬২, ২০১৪ তে ছিল ৭১। মোট জনগোষ্ঠীর ৭৫ শতাংশ কৃষকের রাজ্য পাঞ্জাবের ১৩টি লোকসভা আসনের একটিতেও জেতেনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল।
স্থানীয় একজন বলেন, 'আমাদের মধ্যে কোনো বিশ্বাস, কোনো আস্থা, কোনো আগ্রহের ছিটেফোঁটা নেই। তাই ভোট বা প্রচারণাতেও ছিলাম না। সব বিশ্বাস হারিয়েছি আমরা।'
ভারতের ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গেলো এক দশকে দেশটিতে আত্মহত্যা করেছেন কমপক্ষে এক লাখ ১২ হাজার কৃষক। এর মধ্যে শুধু ২০২২ সালেই আত্মঘাতী হন ১১ হাজারের বেশি কৃষক। ক্ষেত প্রস্তুতের খরচ, বীজ-সার-কীটনাশক আর ট্রাক্টর-পাম্পের মতো কৃষি যন্ত্রাংশের দাম বহন করতে হয় কৃষকদের। উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্য-কৃষিক্ষেত নষ্টের ক্ষতি বহন করতে না পেরে, ঋণে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছেন তারা।
স্থানীয় একজন কৃষক বলেন, 'আমরা যা উৎপাদন করছি, তার মূল্য পাচ্ছি না। বীজ বপন করলেও ফলনের পর সে ফসল বিক্রি হবে কি না, আমরা জানি না। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করে আইন থাকলে একটা সমাধান পেতাম।'
দ্য হিন্দুর বিশ্লেষণ বলছে, গ্রামাঞ্চলে দুই শতাংশের বেশি ভোট কমেছে বিজেপি'র। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের ভোট বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন, সে সময় কৃষি খাতের সংস্কার ও কৃষকদের আয় দ্বিগুণের আশ্বাস দিয়েছিলেন মোদি। তবে আজও দারিদ্রসীমার নিচে আছে ভারতের কৃষকরা। ২০২২ সালের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে একজন কৃষকের দৈনিক গড় আয় মাত্র ২৮ রুপি।
কৃষকদের সংগঠনের সাথে আলোচনা ছাড়াই ২০২০ সালে ভারতের কৃষি খাত নিয়ন্ত্রণে তিনটি বিতর্কিত আইন পাশের চেষ্টা করে মোদি সরকার। পরে বছরব্যাপী ও সহিংস আন্দোলনের মুখে আইন কার্যকর স্থগিত হলেও কমেনি কৃষকদের দুর্ভোগ। শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন দাবিতে গেলো ফেব্রুয়ারি থেকে আবারও রাজপথে লাখো কৃষক। বিশ্লেষকরাও বলছেন, মোদি সরকারের কৃষি নীতিমালা বিগত দুই মেয়াদে কৃষকদের পরিস্থিতি কেবল খারাপের দিকেই নিয়েছে।
স্থানীয় একজন বলেন, 'রাজপথে এতো দীর্ঘ সময় ছিলাম আমরা, আমাদের দিকে টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া হয়েছে। ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে গেছিল, সেই পানি এখনও শুকায়নি। আর এর মধ্যেই তারা আবারও ভোট চাইতে এসে গেছে।'
১৫০ কোটি জনসংখ্যার ভারতে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মোদির শাসনামলে নগরায়ন ও শিল্পায়ন বাড়তে থাকায় আর্থিকভাবে কৃষকরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন বলে বাড়ছে অভিযোগ। বিগত সরকারের ব্যর্থতায় হারানো ভোটারদের ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে নিজের আধিপত্য রক্ষায় এবারও কৃষকদের আয় বাড়ানোর কথা বলছেন মোদি। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা এই প্রধানমন্ত্রী ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে নিতে চান। কৃষিখাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে ২৫ শতাংশে নেয়ার মাধ্যমে কৃষকদের আয় বাড়ানোরও পরিকল্পনা রয়েছে তার। তবে গেলো দুই মেয়াদে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় এবারও মোদির ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না ভারতের অনেক কৃষক।