কিন্তু কেন এই ভ্যাকসিন বৈষম্য? কোভিড মহামারির পরেও কেন অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর স্বার্থ নিয়ে কথা বলতে ভুলে গেল জাতিসংঘ কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা?
সন্তানের ক্ষতস্থানে মলম লাগাচ্ছেন মা। তার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। কবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে তার ৭ বছরের শিশু-এই দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে তার।
আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলীয় শহর গোমা। সেখানে পরিত্যক্ত একটি ইবোলা সেন্টার খুলে দেয়া হয়েছে গৃহহীণদের জন্য। নিজের বড় সন্তান এমপক্সে আক্রান্ত হওয়ায় এই ইবোলা সেন্টারেই ছেলেকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মা এলিজাবেথ।
এলিজাবেথ বলেন, ‘এমপক্সের সংক্রমণ ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিন প্রয়োজন। এই রোগের কারণে আমাদের সন্তানেরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ওদের চোখ লাল, গায়ে জ্বর, পেটে ব্যথা আর সারা শরীরের অ্যালার্জির যন্ত্রণা। একবার ভাবুন, যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসে এখন সন্তানকে হারাতে বসেছি। আপনারা ভ্যাকসিন পাঠাতে দেরি করছেন কেন?’
চলতি মাসে আফ্রিকার পর এশিয়া ও ইউরোপে মাঙ্কিপক্সের নতুন ভ্যারিয়েন্ট 'ক্লেড ওয়ান বি' শনাক্ত হওয়ায় নড়েচড়ে বসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
২০২২ এর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৩৯ হাজার এমপক্স রোগী শনাক্ত হলেও কখনোই ভ্যাক্সিনের দেখা পায়নি মহাদেশটি। অথচ, সে বছর আফ্রিকার বাইরে এমপক্স ছড়িয়ে পড়ায় এটি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের ৭০টি দেশে পৌঁছে দেয়া হয় জীবনরক্ষাকারী টিকা। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কেন এই ভ্যাকসিন বৈষম্য?
আফ্রিকার সিডিসি এমপক্স ইমার্জেন্সি কমিটির সদস্য হেলেন রিস বলেন, ‘ভ্যাক্সিনের সহজলভ্যতার বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসা উচিত। কোভিড মহামারির পর আমরা আবারও একই ভুল করছি। ভ্যাকসিন পেতে আফ্রিকাকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে বারবার সমঝোতায় আসতে হচ্ছে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ভ্যাকসিন বণ্টনের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শুরু থেকেই চাপ দেয়া দরকার ছিল। আমরা কোভিড থেকে কোনো শিক্ষাই আসলে নেইনি।’
ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, সিডিসি বলছে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ১২ লাখ মানুষ এমপক্সের টিকা পেয়েছে। জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের অভিযোগ, দরিদ্র দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার মাধ্যমে এমপক্সের টিকা সরবরাহের দায়িত্ব ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। ২০২৩ সালের মধ্যে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ারও কথা ছিল। তাহলে কেন ২০২৪ এর আগস্ট পর্যন্ত আফ্রিকার জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা করতে হল, সে প্রশ্ন এখন সবার মনে।
গ্লোবাল হেলথ প্রোগ্রামের রিসার্চ ফেলো ইবেরি ওকেরেকি বলেন, ‘যে সব এলাকায় সংক্রমণের মাত্রা ও মৃত্যুঝুঁকি বেশি, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেখানে টিকা পাঠাতে হবে। কোভিডের সময় আমরা যে ভ্যাকসিন বৈষম্য দেখেছি, তার পুনরাবৃত্তি চাই না। অনেকেই বলছেন, আগে নিজ দেশে সংক্রমণ ঠেকানো জরুরি। তবে, বাস্তবতা হচ্ছে রোগের উৎস বন্ধ করতে না পারলে আপনার দেশের মানুষের সুরক্ষাও নিশ্চিত হবেনা।’
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বাইরে গেল দুই বছরে মহাদেশটিতে কোন ভ্যাকসিন পাঠানো হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন ছাড়া ভ্যাকসিন কিনতে পারে না টিকা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গাভি বা ইউনিসেফ। অনুন্নত দেশগুলোর প্রতি ডব্লিউএইচওর এই বৈষম্যমূলক আচরণ পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।