ওয়াক্ফ সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে, ভারতে মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ

বিদেশে এখন
0

ওয়াকফ বোর্ড নয়, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে ওয়াকফ সম্পত্তি এমন বিতর্কিত ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের মাঝে। পশ্চিমবঙ্গ, জম্মু-কাশ্মিরসহ বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলে হয়েছে বিক্ষোভ। বিল প্রত্যাহারের দাবিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন মুসলিম নেতারা। অভিযোগ, আইন সংশোধনের নামে মুসলিমদের স্থাবর সম্পত্তি দখলে নিতে চাইছে মোদি সরকার।

ভারতের পার্লামেন্টে এমন উত্তেজনা-সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবার লোকসভায়, শুক্রবার (৪ এপ্রিল) রাজ্যসভায়ও বিতর্কিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস হয় দীর্ঘ বিতর্কের মধ্য দিয়ে। আর এই ইস্যুতে দেশজুড়ে ক্ষুব্ধ-আতঙ্কিত সংখ্যালঘু মুসলিমরা।

ভারতীয় মুসলিমদের একজন বলেন, ‘রাত ২টার দিকে দেশের কোন আইন বেঁচে থাকে যে এই সময়ে তারা বিল পাস করে?’

আরেকজন বলেন, ‘মুসলমানদের লাভের জন্য এই আইন এসেছে তো? নরেন্দ্র মোদিজিকে বলছি যে পরেরবার আপনি আরেকটি আইন আনুন যেখানে মন্দিরে, মঠে, আশ্রমে দলিত, আদিবাসী, আর সমাজে যাদের নিচু-অতি নিচু শ্রেণির আপনারা বলেন, তারা অধিকার পাবেন। তাদের পূজা করার অধিকার দিন। অংশীদার বানান।’

ওয়াকফ হলো মুসলিমদের দাতব্য বা ধর্মীয় অনুদান, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণে ব্যবহার করা হয়। অন্য কোনো কাজে এ ধরনের সম্পদ ব্যবহার, বিক্রির বা মালিকানা হস্তান্তরের অনুমতি নেই। 

দেড়শো' কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের সংখ্যালঘু ২০ কোটি মুসলিমের জন্য ওয়াকফ জরুরি, কারণ তাদের মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও এতিমখানা পরিচালিত হয় ওয়াকফ বোর্ডের মাধ্যমে। 

১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনের মাধ্যমে রাজ্য পর্যায়ে বোর্ড বা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে চলে এসব সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ। 

ওয়াকফ'র রাজ্য পরিচালনা পর্ষদে থাকেন রাজ্য সরকার, মুসলিম আইনপ্রণেতা, রাজ্য বার কাউন্সিল, ইসলামিক শিক্ষাবিদ ও ওয়াকফ ব্যবস্থাপকরা যাদের সবাই মুসলিম। 

সংশোধিত আইনে দুর্নীতি দমনের নামে অমুসলিমদেরও ওয়াকফ পরিচালনায় যুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।

ভারতের রাজ্যসভা সদস্য ইমরান প্রতাপগড়ী বলেন, ১৯৪৭ সালে দিল্লির জামে মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সাহেব বলেছিলেন, 'মুসলমান ভাইবোনেরা, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? এই দেশ তোমাদের। এখানে তোমাদের পূর্বপুরুষদের কবর। সে সময় মাওলানা আজাদের এই ভাষণ শুনে শ্রদ্ধায় নত মানুষ মাথার পাগড়ি খুলে রেখে দিয়েছিল। আজ সেই দিল্লিতেই অবস্থিত দেশের সংসদে এক বিল এলো যা ওই জামে মসজিদেরই সিঁড়িই আমাদের কি না, সে প্রমাণ চাইছে।’

গেল বছর আগস্টে ওয়াকফ আইন সংশোধনে বিল আনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার। যাচাই-বাছাইয়ের পর কিছু সংশোধনী দিয়ে গেল ফেব্রুয়ারিতে বিলটি পার্লামেন্টে উপস্থাপনের জন্য ছাড় দেয় সংশ্লিষ্ট প্যানেল। 

যার ধারাবাহিকতায় টানা উত্তপ্ত বিতর্কের পর গত দু'দিনে পার্লামেন্টে পাস হয় বিলটি, আইন হিসেবে কার্যকরে বাকি প্রেসিডেন্টের সই। 

মোদির সরকারের দাবি, আইন সংশোধনের মাধ্যমে ওয়াকফ প্রশাসনের আধুনিকায়ন হবে, কমবে আইনি ফাঁকফোকর। 

মুসলিম নেতা ও বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, আইন সংশোধনের নামে মূলত মুসলিমদের স্থাবর সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে মোদি সরকার। 

সংশোধিত আইনের মাধ্যমে মোদি প্রশাসন ওয়াকফ ব্যবস্থাপনায় আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির দাবি করলেও একে অসাংবিধানিক এবং সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার খর্বের কৌশল বলছেন বিরোধীরা।

ভারতের বিজেপি এমপি কঙ্গনা রানাওয়াত বলেন, ‘মোটা দাগে কথা এটাই যে কোনো ব্যক্তি, কোনো সংস্থা, কোনো ধর্মীয় সংগঠন এ দেশের আইন ও সংবিধানের চেয়ে বড় নয়। এই বিলের মোদ্দা কথা বা সারমর্ম সেটাই যে দেশের সংবিধানের আগে কেউ নয়। আজকের দিন তো আমাদের জন্য সৌভাগ্যের। দেশকে খেয়ে ফেলতে বসেছিল যে দুর্নীতি, আজ আমাদের দেশ তা থেকেও মুক্ত হলো।’

ভারতের লখনৌ  ধর্মীয় নেতা বলেন, ‘বিজেপি মুসলিমদের কল্যাণে কোনোদিন কোনো কাজ করেছে? আজ বললেই আমরা মেনে নেবো যে এ কাজে আমাদের কল্যাণ? সবসময় আমাদের আঘাতই করে এসেছে। উকিল সাহেব মাত্রই পড়ে শোনালেন যে এ আইনের মাধ্যমে বড় বড় যতো সম্পদ, চাইলেই সরকার কব্জা করে নিতে পারবে। এর বিরুদ্ধে আপিলও করা যাবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন আইন এটি। ব্রিটিশরাও এ ধরনের আইন তৈরি করেনি।’

নিম্মকক্ষে বিলের পক্ষে ২৮৮ ও বিপক্ষে ২৩২ ভোটের কথা উল্লেখ করে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, বিভিন্ন দল থেকে তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও বিলটি পার্লামেন্টে ওঠায় সরকারি দল। 

শুক্রবার আইনবিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভল জানায়, লোকসভায় হায়দ্রাবাদ আসনের পাঁচবারের আইনপ্রণেতা ও সর্বভারতীয় মহলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বিলটিকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। সংখ্যালঘু মুসলিমদের অধিকার হরণে সংখ্যাগরিষ্ঠদের অপব্যবহার করছে মোদি সরকার, এমন অভিযোগে পিটিশন ফাইলও করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে।

ইএ