মুয়াম্মার আল আলি বলেন, ‘আমার মায়ের মন বলতো, তার ছেলে নিশ্বাস নিচ্ছে, মরে যায়নি। ভিডিওতে ছবি দেখেই চিনতে পেরেছিলাম আমার ভাইকে। এখন ওকে অনেক বয়স্ক দেখাচ্ছে, কিন্তু ও আমার ভাই।’
মুয়াম্মার আল আলি মাত্রই জানতে পেরেছেন ৪০ বছর ধরে নিখোঁজ থাকা ভাই আলি হামার কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন। যদিও এতো বছর পর ভাইকে চিনে নিতেও বেশ কষ্ট হয়েছে তার। হামায় থাকা সিরিয়ার এক সাংবাদিকের ধারণ করা ভিডিও দেখে নিজের ভাইকে শনাক্ত করেন আল আলি। কিন্তু জানতে পারেন, তার ভাই স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
তিনি বলেন, ‘ভিডিও দেখে সাংবাদিক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি জানান, তার পাশে যে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি লেবাননের নাগরিক। ৪০ বছর কারাগারে থেকে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।’
সিরিয়ার স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাবা হাফেজ আল আসাদের শাসনামলে ১৯৭৫ থেকে ৯০ সালের গৃহযুদ্ধে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সিরীয় সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হন আলি। তার খোঁজে আলির পরিবার কাটিয়ে দিয়েছে কয়েক দশক। সিরিয়ার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ভাইকে খুঁজতে যাননি আলি ও তার পরিবার। আলির মা ছেলের খোঁজে ধরনা দিয়েছেন কারাগারগুলোতেও।
কিনি আরো বলেন, ‘ভাই বলেছিলো সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। দুই সপ্তাহ পর চলে আসবেন, যদি সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে না পারেন, সিদন গিয়ে কাজ খুঁজবেন।’
গেলো রোববার আসাদ প্রশাসনের স্বৈরশাসনের অবসানের পর সিরিয়ার বিভিন্ন কারাগার থেকে উদ্ধার হয়েছেন আলির ভাইয়ের মতো অনেকেই। ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সিরিয়া থেকে নিখোঁজ হয়েছেন অন্তত ১ লাখ বাসিন্দা, যাদের বেশিরভাগই কারাবন্দি ছিলেন।
আলেপ্পো, হামাসহ বেশ কয়েকটি শহর আসাদ বিরোধীদের দখলে যাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে কারাবন্দিদের ভিডিও। এমন বন্দিদেরও মুক্ত করেছে বিদ্রোহীরা, যাদের সেদিনই হত্যা করার কথা ছিল।
আরেকজন বলেন, ‘গতকালই আমাকে মেরে ফেলা হতো। আধা ঘণ্টা আগে পরিকল্পনা ছিল আমাদের মধ্যে ৫৪ জনকে হত্যা করা হবে।’
হায়াত তাহরীর আল শামের অভিযানে আলেপ্পোর কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া আরেক কয়েদির মন্তব্য - আমার নম্বর এক এক শূন্য শূন্য। ৬ বছর কারাগারে থেকে নিজের নামই ভুলতে বসেছিলেন তিনি।
প্রায় দেড় লাখ কারাবন্দির একজন হামলাকে ২০১৯ সালে সন্ত্রাসীর তকমা দিয়ে হামা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো সিরীয় সেনারা। আসাদ সরকারের বিরোধিতা করা যেকোনো ব্যক্তিকেই সন্ত্রাসীর তকমা দিয়ে কারাবন্দি করে রাখা হতো বছরের পর বছর।
২৪ বছর ধরে স্বৈরশাসকের ভূমিকায় থাকা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অন্যতম হাতিয়ার ছিল সিরিয়ার কারাগারগুলো। সিরিয়ার মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এখানে কয়েদিদের অমানবিক নির্যাতন করা হতো, খাবার দেয়া হতো না, রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়তো কারাগারগুলোয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মানুষের কসাইখানা নাম দেয়া সেদনায়া কারাগারে কয়েদিদের করা হতো সবচেয়ে নির্মম নির্যাতন।
এই কারাগার থেকে ৪৩ বছর পর মুক্ত হয়েছেন রাঘাদ আল টাটারি, ১৯৮০ সালে হাফেজ আল আসাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় হামা শহরে বোমা হামলা চালাতে অস্বীকৃতি জানালে এই বৈমানিককে গ্রেপ্তার করে রাখা হয়।
সিরিয়ার সিভিল ডিফেন্স গ্রুপ হোয়াইট হেলমেট বলছে, এই সেদনায়া কারাগারে থেকে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত খাবার ও চিকিৎসার অভাব এবং নির্যাতনের কারণে ৩০ হাজার বন্দির মৃত্যু হয়েছে। আরও ৫ শতাধিক কারাবন্দিকে হত্যা করা হয়েছে। স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা গেছে, এই কারাগারের ভেতর তৈরি করা হয়েছিলো মরদেহ পোড়ানোর চুল্লি।
সিরিয়ায় সরকারবিরোধীদের দখলে নেয়া সব শহর থেকেই বন্দিদের মুক্ত করে দেয় হায়াত তাহরীর আল শাম। এই সংগঠনের প্রধান আবু মোহাম্মদ আল জুলানির নেতৃত্বে রোববার ২৪ বছরের স্বৈরশাসনের পতন হয়।
কারাবন্দিদের অনেকেই জানেন না, বাশার আল আসাদের বাবা হাফেজ আল আসাদের মৃত্যু হয়েছে, যার আমল থেকে তারা কারাবন্দি ছিলেন। এইচটিএস'এর আসাদবিরোধী যোদ্ধাদের কারণে ১ লাখের বেশি কারাবন্দির সৌভাগ্য হয়েছে বহু বছর পর দেখছে দিনের আলো দেখার।