চলতি মাসে বায়ুদূষণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর তালিকার শীর্ষে দেশ দু'টির একাধিক শহর। শনিবার (২৩ নভেম্বর) ছিল না ব্যতিক্রম।
বাসিন্দাদের একজন বলেন, ‘দূষণে এতোটাই অতিষ্ঠ হয়ে আছি, বলার মতো না। চোখ জ্বলছে, পানি এসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ আমার চোখে মরিচ ডলে দিয়েছে।’
চলতি মাসে ভারতের রাজধানী দিল্লি এবং পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর লাহোরে বায়ুমান সূচক দুই হাজার পার হয়েছিল। যেখানে মানবস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ সীমা সর্বোচ্চ ৩শ'। বিষাক্ত বাতাস আর ধোঁয়াশার পুরু আস্তরে ঢেকে গিয়েছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
বাতাসে ধাতব কণা পিএম টু পয়েন্ট ফাইভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল মানবদেহে সহনসীমার দেড়শ' থেকে ২শ' গুণে। সব মিলিয়ে আক্ষরিক অর্থেই বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে রূপ নিয়েছে মানুষের বসতি। তীব্র দূষণে শ্বাসপ্রশ্বাসের জটিলতাসহ নানা রোগে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ হন লাখো মানুষ।
বাসিন্দাদের আরেকজন বলেন, ‘দূষণ অনেক বেশি। ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা অনেক কমে গেছে। এখানে আসার সময় চোখ জ্বলছিল। শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। গলায় এখনও ব্যথা আছে।’
দূষণ সারা বছর হলেও প্রতি শীতে ঘন কুয়াশা, কম তাপমাত্রা, বাতাস ভারী হওয়া ইত্যাদি কারণে তীব্র ধোঁয়াশায় ঢেকে যায় দুই দেশের বড় অংশ। যানবাহন ও কলকারখানার কার্বন নিঃসরণের পাশাপাশি ফসল উত্তোলন শেষে এ সময়ে ক্ষেতে আগাছা পোড়ানো ধোঁয়াকেও দূষণের বড় কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।
ভারতের পরিবেশবিদ মোহন জর্জ বলেন, ‘এই সময়ে দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কৃষি জমিতে পড়ে থাকা আগাছা পোড়ানো এবং যানবাহনের ধোঁয়া। আগাছা পোড়ানো তো নিয়মিত ঘটনা কারণ ফসল উত্তোলনের পর খুব দ্রুত খেত পরিষ্কারের দরকার হয়। এজন্য আগাছা পুড়িয়ে ফেলা কৃষকদের জন্য সবচেয়ে সহজ।’
প্রতিবেশী দুই দেশেই সমস্যা এক। দূষিত বাতাসে সবচেয়ে বিপাকে সীমান্তবর্তী পাঞ্জাব প্রদেশ। ভারতের রুটির ঝুড়ি খ্যাত পাঞ্জাব ও হরিয়ানা প্রদেশে ধানের মৌসুম শেষে গমের বীজ বপনের জন্য খেত প্রস্তুত করতে ২০ থেকে ২৫ দিন চলে আগাছা পোড়ানোর কাজ। তবে এ বছর দূষণের ভয়াবহতায় গম রোপণে পরিবেশবান্ধব পথ অবলম্বন করছেন পাঞ্জাবের অনেক কৃষক।
চাষিদের একজন বলেন, ‘এখানে মাল্চিং পদ্ধতি ব্যবহার করে গম চাষ করছি আমরা। এই পদ্ধতিতে বীজে পানি দিতে হয়। আর খেতে বিছানো খড় বীজ অঙ্কুরিত হতে প্রয়োজনীয় তাপ সরবরাহ করে। পরে আবার এসব খড় জৈবসার হিসেবে কাজে লাগে।’
কৃষকদের এ কাজে সাহায্য করছে একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা। আগাছা পুড়িয়ে দূষণ বাড়ানোর পরিবর্তে পরিষ্কার ও পরিবেশবান্ধব মাল্চিং পদ্ধতি বেছে নিতে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে সংস্থাটি।
কৃষকদের একজন বলেন, ‘কৃষকরাও আগাছা পোড়ানোর বদলে বিকল্প পথই চায়। কেউই আগুন জ্বালাতে চায় না। অনেকেই অনেক ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে এখন পর্যন্ত মাল্চিংই সেরা।’
মাটির ওপরের অংশ ঢেকে চাষাবাদ করার পদ্ধতিকে বলা হয় মাল্চিং। এ পদ্ধতিতে মাটির ওপরে গাছের পাতা, ঘাস, ডালপালা, শস্যের আগাছা, খড় ইত্যাদি বিছিয়ে জমির আর্দ্রতা রক্ষা ও উর্বরতা বৃদ্ধি করা হয়। ট্র্যাক্টরের সঙ্গে আগাছা কাটা এবং বীজ বপনের যন্ত্র যোগ করে মাল্চিং পদ্ধতিতে কাজ করেন কৃষকরা।
ভারতের পাঞ্জাবের ক্ষেতি ভিরাসাত মিশনের কর্মী জাগতার সিং বলেন, ‘মাল্চিং পদ্ধতিতে বীজ বপনের কথা যদি বলি, একজন কৃষক আগে দুই একর জমিতে এ পদ্ধতিতে কাজ করলে এখন ২৫ একর জমিতে এ পদ্ধতিটি প্রয়োগ করছেন। এক গ্রামে দু'জন এ পদ্ধতিতে কাজ করলে কমপক্ষে আরও ২০ জন এ পদ্ধতিতে কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। কিন্তু আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই।’
খেতে আগাছা না পুড়িয়ে পরিষ্কার ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অবলম্বন ব্যয়বহুল। এতে সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা দরকার বলে মত কৃষকদের।