বিশ্বের যেসব দেশে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও মর্যাদাপূর্ণ নির্বাচন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর এই নির্বাচন ব্যবস্থাও পৃথিবীর অন্যতম জটিল নির্বাচনী প্রক্রিয়া হিসেবে পরিচিত।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে 'ইলেকটোরাল কলেজ' নামে পদ্ধতিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজনকে বেছে নেওয়ার জন্য প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে 'ইলেকটর' বা নির্বাচকদের মনোনয়ন দেয়া হয়ে থাকে। 'ইলেকটর' নামে মনোনীত নির্বাচকরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। যার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন আইন পরিষদ কংগ্রেস।
সাধারণ নির্বাচনের আগে দুই দলের পক্ষ থেকে তাদের মনোনীত ইলেকটোরাল ভোটারের তালিকা জমা দেওয়া হয়, যাকে স্লেট বলে। কোন অঙ্গরাজ্যে কত ইলেকটোরাল ভোট থাকবে, তা নির্ধারিত হয় সেখানে কতটি কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট রয়েছে তার ওপর। প্রতিটি কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্টের জন্য একটি করে ভোট এবং দুজন সিনেটরের জন্য দুটি ভোট বরাদ্দ থাকে।
মার্কিন সংবিধানের ২৩তম সংশোধনী ধারায় বলা হয়, 'যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্য ছাড়াও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার জন্য অতিরিক্ত ৩ জন ইলেকটর নিয়োগ করা যাবে। এই পদ্ধতির স্বার্থেই নির্বাচনের সময় ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়াকেও আলাদা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কাগজে-কলমে ইলেকটরদের ভোটেই নির্বাচিত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট।
নির্বাচনের দিন ভোটাররা মূলত প্রার্থীদের বাছাই করা ইলেকটরদের ভোট দিয়ে থাকেন। দুটি ছাড়া বাকি ৪৮টি অঙ্গরাজ্যে 'উইনার-টেকস-অল', অর্থাৎ জয়ী প্রার্থী ওই অঙ্গরাজ্যের জন্য বরাদ্দকৃত সবগুলো ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়ে থাকেন।
এদিন প্রার্থীরা সারা দেশে ভোটারদের কাছ থেকে যেসব ভোট পান, সেগুলোকে বলা হয় পপুলার ভোট এবং ইলেকটোরাল কলেজের ভোটকে বলা হয় ইলেকটোরাল ভোট। কোনো একটি অঙ্গরাজ্যে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি পপুলার ভোট পাবেন, তিনি ওই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যাবেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ও কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে। আর তাই এই অঙ্গরাজ্যটিকে এবার ইলেকটর বা নির্বাচকের সংখ্যা ৫৪টি। আসন্ন নির্বাচনে ট্রাম্প কিংবা কামালা যেই এই অঙ্গরাজ্যটিতে সবচেয়ে বেশি পপুলার ভোট পাবেন, তার ঝুলিতেই যাবে ওই অঙ্গরাজ্যের জন্য বরাদ্দকৃত সবগুলো ইলেকটোরাল কলেজ ভোট।
তবে, এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মেইন ও নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্য ব্যতিক্রম। এ দুই অঙ্গরাজ্যে আনুপাতিক হারে ইলেকটোরাল ভোটার বণ্টিত হয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে মেইন অঙ্গরাজ্যে বিজয়ী হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু আনুপাতিক হারে নির্ধারিত চারটি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে হিলারি পেয়েছিলেন তিনটি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি।
এভাবে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজের মধ্যে কেউ যদি অর্ধেকের চেয়ে একটি বেশি, অর্থাৎ অন্তত ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পান, তবে তিনি হবেই যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। অর্থাৎ পপুলার ভোটে নয়, একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মোট কতটি অঙ্গরাজ্যে জয়ী হলেন এবং সেসব অঙ্গরাজ্যের জন্য বরাদ্দ থাকা নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেকটোরাল ভোট মিলিয়ে মোট কতটি ইলেকটোরাল ভোট পেলেন তার উপরই নির্ভর করে কে হচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন দেশটির বিশাল আকার-আয়তন এবং নানা প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ কঠিন হওয়ার কারণে জাতীয়ভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তখনো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয় ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি, অঙ্গরাজ্যগুলোও তাদের নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে ছিল অনেক বেশি সোচ্চার। এছাড়াও, রাজনৈতিক দলগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো এবং পপুলার ভোটকে মানুষ ভয় পেত। এ কারণে সংবিধানপ্রণেতারা ১৭৮৭ সালে সংবিধান রচনার সময় কংগ্রেস ও জনগণের সরাসরি ভোট বা পপুলার ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ধারণা বাতিল করে দেন।
সংবিধানপ্রণেতাদের যুক্তি ছিল, পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ভোটাররা তাঁদের স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেবেন এবং এর ফলে বড় অঙ্গরাজ্যগুলো আধিপত্য বিস্তার করবে। পাশাপাশি ছোট অঙ্গরাজ্যগুলোও এই ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির প্রতি সমর্থন দেয়, কারণ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।