শিল্পকারখানা ধ্বংস, রাস্তাঘাট টুকরো টুকরো, পাওয়ার প্ল্যান্ট অকেজো, ইস্পাতের রপ্তানি বন্ধ ও দেশের বাইরে শরণার্থীদের ঢলে ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ এখন ইউক্রেন। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বিপর্যস্ত এই দেশ। এখন পর্যন্ত দেশটির ৭০ লাখ মানুষ চরম সংকটে পড়ে গেছে। ১৫ বছরের অগ্রগতি দুই বছরেই ধুলোয় মিশে গেছে। অর্থনীতি প্রায় ৩০ শতাংশ সংকুচিত হয়ে গেছে।
ইউরোপের পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিটা জাভোরকিক বলছেন, ব্যবসায়িক এলাকাগুলো এখনও তুলনামূলক সহিংসতামুক্ত আছে পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমেছে। কিন্তু এখনও ইউক্রেন কঠিন বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সামরিকভাবে স্থিতিশীল থাকতে দেশটির প্রয়োজন ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি। বিশ্বব্যাংক বলছে, ১০ বছরে দেশ পুনর্গঠনে প্রয়োজন প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলার।
উল্টোদিকে পাশের দেশে এতো বড় আগ্রাসন চালিয়েও অর্থনীতি নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হচ্ছে না রাশিয়াকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাস ছিলো, দুই বছরে ভয়াবহ মন্দার কবলে পড়বে মস্কো। আশঙ্কা ছিলো ২০২২ সালে অর্থনীতি সংকুচিত হবে সাড়ে ৮ শতাংশ, হয়েছে ২ শতাংশ। আইএমএফ বলছে, ২০২৩ সালে অর্থনীতি সম্প্রসারিত হয়েছে ৩ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, বেশ পরিকল্পনা করেই যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি কমিয়ে এনেছিলেন জিডিপি অনুপাতে ঋণ। গেল বছর বাজেট ঘাটতিও ছিল জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ। জানুয়ারি নাগাদ মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে অর্ধেকে। যুদ্ধ শুরুর সময় ইউক্রেনের চেয়ে ১০ গুণ বড় ছিলো রুশ অর্থনীতি। সামরিক খাতে অপ্রত্যাশিত ব্যয় বাড়িয়েছে প্রবৃদ্ধি। এই সংঘাতের জন্য রাশিয়াকে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত করছিলেন পুতিন। যে কারণে জ্বালানি তেল আর গ্যাস ব্যবহার করে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা যেন প্রভাব ফেলতে না পারে, অথর্নীতিকে সেভাবে গুছিয়েছিলেন তিনি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছাতাম হাউজের রুশ গবেষক টিম এশ বলেন, শুধু পুতিনই জানতেন যে যুদ্ধ হবে, সেজন্য তার প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটস অধ্যাপক মার্ক হ্যারিসন বলেন, জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশই প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করছেন পুতিন, আগামী বছর যেটা ১০ শতাংশ হবে। গবেষকরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার সেরকম প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়েনি, উল্টো পশ্চিমা আমদানি পণ্য নির্ভরতা কমিয়ে ফেলেছে রাশিয়া। চীন, তুর্কিয়ে থেকে পণ্য আমদানি করছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ধীরে হলেও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রাশিয়ার ওপর। রুশ নাগরিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করছে আরব আমিরাত। রুশ প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করলে বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন ছিন্ন করা হবে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন ঘোষণার পর কয়েকটি চীনা ব্যাংক আর তুর্কিয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান সতর্ক হয়ে গেছে। রুশ জব্দ করা অর্থ যেন ইউক্রেনের পুনর্গঠনে ব্যবহার করা হয়, সেজন্য চাপ দিচ্ছে জি সেভেন।
এই বিতর্কের মধ্যেই ইউক্রেন চরম নগদ অর্থ সংকটে পড়েছে। এই শূন্যস্থান পূরণে প্রয়োজন প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলার। চলতি বছর বাজেটে ব্যয় হবে ৮ হাজার ১শ' কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতেই ব্যয় হবে ৪ হাজার ২শ' কোটি ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থ সহায়তা ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধে জিততে পারবে না। সেই সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোকে দ্বিতীয়বারের মতো শরণার্থীর ঢল সামলাতে হবে।