২০২০ সালে কাজের ভিসা নিয়ে কম্বোডিয়ার পাড়ি দেন পাবনার সুজানগরের আল আমিন। বছর চারেক ঘুরতেই খবর আসে কর্মসংস্থলে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনি। এর পর শুরু হয় স্বামীর মরদেহ আনার যুদ্ধ। প্রবাসী কল্যাণ ও বিভিন্ন সংস্থার কাছে ধর্না দিলেও এখনো পর্যন্ত তার মরদেহ বুঝে পাননি পরিবার।
আল আমিনের স্ত্রী মুন্নি খাতুন বলেন, ‘আমাকে একটি ভিডিও পাঠানো হয়, সেখানে আমি দেখি। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক যেহেতু সরকার দেশে ফিরিয়ে আনবেন। তবে আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম কোনো সহযোগিতা পাইনি।’
এবারের গল্পটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নবীনগর গ্রামের ইব্রাহিম হোসেনের। কম্বোডিয়া যাবার তিন মাসের মাথায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান । ছেলের শোক ও মরদেহ দেখার অপেক্ষায় থেকে থেকে চার মাস পর মারা যান মা মুর্শেদা বেগমও। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করার পর কেটে গেছে প্রায় ১৪ মাস। এখনো দেশে আসেনি ইব্রাহিমের মরদেহ। স্ত্রী রাবেয়া বেগম, দুই সন্তান ও তার পরিবার এখনো শেষবার এই প্রবাসীকে দেখার অপেক্ষায় দিন পার করছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইব্রাহিমের স্ত্রী রাবেয়া বেগম বলেন, ‘আজ প্রায় এক বছর চার মাস হলো তিনি মারা গেছেন। দেশে লাশ ফিরানো হচ্ছে না। আমাদের কাছে ১৭ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে এ বিষয়ে।’
অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ইব্রাহিমের স্ত্রীর আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে মরদেহ জরুরি ভিত্তিতে দেশে পাঠাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে চিঠি দেয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। নভেম্বর মাসে মৃতদেহের পরিবহন খরচের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি লেখে প্রবাসী মন্ত্রণালয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়, কম্বোডিয়া থেকে এ প্রবাসীর মরদেহে দেশে আনতে খরচ হবে প্রায় ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা। এ ব্যয় ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের সচিবালয়ের অনুকূলে বরাদ্দকৃত মরদেহ উপখাত হতে বহন করার কথা। কিন্তু এ চিঠির এক বছর পেরিয়ে গেলেও ইব্রাহিমের লাশ দেশে আনাতে পারেনি মন্ত্রণালয়। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বলছে, বিএমইটি কার্ড না থাকায় তারা মরদেহ দেশে আনা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
পাবনা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রকল্প পরিচালক ড. এ টি এম মাহবুব উল করিম বলেন, ‘যিনি মারা গেছেন তার বিএমইটি কার্ড বা ছাড়পত্র ছিলো না। তাই আইন অনুযায়ী তাদের ডেড বডি ফিরিয়ে নিয়ে আসার কাজ আমরা করতে পারিনি। তবে পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে মন্ত্রণালয় ইস্যু করে। যাতে বডি আনতে যে ১০ লাখ টাকা খরচ হয় সেটি মঞ্জুর করা হয়।’
পাবনার আল আমিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইব্রাহিম মারা গিয়ে বেঁচে গেছেন। কিন্তু যারা দেশটিতে আছেন কিংবা নতুন করে যাচ্ছেন তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। গত দুই বছরে অনেকেই দালালের প্রলোভনে পড়ে কম্বোডিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। কেউ ৫ লাখ, কেউ ৬–৭ লাখ টাকা পর্যন্ত ধারদেনা করে, জমি বন্ধক রেখে পাড়ি দেন সেখানে। কিন্তু প্রতিশ্রুত চাকরি কিংবা বেতন তো দূরের কথা—তাদের অনেকেই পৌঁছানোর পর থেকেই শিকার হন অবৈধভাবে আটকে রাখা, অতিরিক্ত শ্রম, মারধর ও অমানবিক নির্যাতনের। কেউ কেউ প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরতেও বাধ্য হয়েছেন।
ফেরত আসা প্রবাসীদের একজন বলেন, ‘আমি ছিলাম ১৭ দিনের মতো। আমরা কোনো কাজ করতেই পারিনি। আমাদের থাকা খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক ছিলো না। তাদের কথা মতো না চললে মেরে ফেলার হুমকিও দিতো তারা।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কম্বোডিয়ায় ৯ হাজার ৩৫৬ শ্রমিক পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য এই শ্রমবাজার সম্ভাবনাময়। তবে নজরদারির অভাবে কর্মীদের কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টার ব্যবস্থাপক আল আমিন নয়ন বলেন, ‘যে কর্মীরা গেছেন তারা কি অবস্থায় আছে এটি যদি তারা দেখেন তারা যদি সেখান থেকে প্রতিবেদন নিয়ে আসেন ফাইন। ঠিকভাবে কাজ না করলে এখনই স্টেপ নিতে হবে। আমরা কিছু এজেন্সির নাম পেয়েছি তাদের মালিকরা কম্বডিয়াতেই আছে।’
বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক সাকিল আখতার চৌধুরী বলেন, ‘কম্বোডিয়াতে নিয়মিত উপায়ে লোক যাওয়ার পরিমাণ খুবই কম। বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে লোক প্রেরণ করার প্রবণতা আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। থাইল্যান্ডের যে দূতাবাস রয়েছে তার পক্ষে কম্বোডিয়াতে গিয়ে শ্রমিকদের বা প্রবাসীদের দেখার বিষয়টি কার্যকর না। থাইল্যান্ডের সঙ্গে কম্বোডিয়ার একটি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কের কারণে সেখানে থাকা সানুষেরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। অভিবাসী শ্রমিকরা সবসময়ই ঝুঁকির উচ্চ পর্যায়ে থাকে।’
এতোসব সংকটের মধ্যে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার চলমান সীমান্ত বিরোধ অভিবাসী কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়েও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে।




