প্রিয় পোষা প্রাণীকে নিয়ে ভ্রমণে যাচ্ছেন? জেনে নিন আইনি প্রক্রিয়া ও কাগজপত্র

গাড়িতে পোষা প্রাণী নিয়ে ভ্রমণের টিপস
গাড়িতে পোষা প্রাণী নিয়ে ভ্রমণের টিপস | ছবি: এখন টিভি
0

উচ্চশিক্ষা, অভিবাসন বা চাকরির প্রয়োজনে আমরা যখন বিদেশে পাড়ি জমাই, তখন প্রিয় পোষা প্রাণীটিকে (Pet) দেশে ফেলে যাওয়া অনেকের জন্যই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে চাইলেই হুট করে কোনো প্রাণী বিদেশে নিয়ে যাওয়া যায় না। দেশ থেকে বিড়াল, কুকুর বা অন্য কোনো প্রাণী বিদেশে নেওয়ার জন্য পাড়ি দিতে হয় বেশ কিছু আইনি ও স্বাস্থ্যগত ধাপ।

সঠিক নিয়ম ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নীতি (International Travel Policy) না জানলে বিমানবন্দর থেকে আপনার প্রিয় সঙ্গীকে ফিরিয়ে দেওয়া হতে পারে। চলুন জেনে নিই দেশ থেকে পোষা প্রাণী বিদেশে নেওয়ার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া।

আরও পড়ুন:

একনজরে: পোষা প্রাণীর বিদেশ যাত্রা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

ধাপসময়সীমাপ্রধান কাজ
প্রস্তুতি৪-৬ মাস আগেমাইক্রোচিপ ও র‍্যাবিস ভ্যাকসিন।
পরীক্ষা৩ মাস আগেটিটার টেস্ট (রক্ত পরীক্ষা) ও রিপোর্ট সংগ্রহ।
অনুমতি১৫ দিন আগেপ্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে এনওসি (NOC) নেওয়া।
ক্লিয়ারেন্স২-৩ দিন আগেহেলথ সার্টিফিকেট ও এয়ারপোর্ট কোয়ারেন্টাইন অনুমতি।
যাত্রাফ্লাইটের দিন"৫ ঘণ্টা আগে খাবার বন্ধ, পানির ড্রিপার চেক।"

পোষা প্রাণী নিয়ে ভ্রমণের নিয়ম |ছবি: এখন টিভি

পোষা প্রাণীকে বিদেশে নেওয়ার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া (Step-by-Step Process)

১. মাইক্রোচিপ স্থাপন (Microchipping Pets): বিদেশের বেশিরভাগ দেশে প্রাণীর শরীরে একটি আইএসও স্ট্যান্ডার্ড মাইক্রোচিপ (ISO Standard Microchip) থাকা বাধ্যতামূলক। এটি মূলত চালের দানার মতো ছোট একটি চিপ যা প্রাণীর ঘাড়ের চামড়ার নিচে স্থাপন করা হয়। এতে একটি নির্দিষ্ট কোড থাকে যা স্ক্যান করলে ওই প্রাণীর সব তথ্য পাওয়া যায়।

২. টিকাদান ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা (Vaccination and Health Check-up): পোষা প্রাণীকে বিদেশে নেওয়ার অন্তত ১ মাস আগে সব ধরণের টিকা বা ভ্যাকসিন (Vaccination) সম্পন্ন করতে হবে। বিশেষ করে র‍্যাবিস টিকা (Rabies Vaccine) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। টিকার যাবতীয় তথ্য একটি অনুমোদিত ভ্যাকসিনেশন কার্ডে (Vaccination Card) লিপিবদ্ধ থাকতে হবে।

৩. টিটার টেস্ট বা রক্ত পরীক্ষা (Rabies Titer Test): ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ বা জাপানের মতো দেশে যেতে হলে র‍্যাবিস টিটার টেস্ট (Rabies Titer Test) রিপোর্ট প্রয়োজন হয়। টিকার কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্ত পরীক্ষা করে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়। বাংলাদেশ থেকে অনেক সময় রক্ত সংগ্রহ করে বিদেশের ল্যাবে পাঠিয়ে এই রিপোর্ট আনতে হয়, যাতে ৩-৪ মাস সময় লাগতে পারে।

আরও পড়ুন:

৪. অনাপত্তি পত্র বা এনওসি সংগ্রহ (NOC from Department of Livestock Services): বাংলাদেশ থেকে প্রাণী রপ্তানি বা বিদেশে নেওয়ার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (Department of Livestock Services) থেকে একটি অনাপত্তি পত্র বা এনওসি (NOC) সংগ্রহ করতে হবে। এটি ছাড়া কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পাওয়া অসম্ভব।

৫. হেলথ সার্টিফিকেট (Veterinary Health Certificate): যাত্রার মাত্র ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা আগে একজন নিবন্ধিত পশুচিকিৎসক (Veterinary Surgeon) থেকে স্বাস্থ্য সনদ নিতে হবে। যেখানে উল্লেখ থাকবে যে প্রাণীটি বর্তমানে সুস্থ এবং দীর্ঘ আকাশপথ ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত।

৬. এয়ারলাইন ও ট্রাভেল ক্রেট নির্বাচন (Airlines and Travel Crate): সব এয়ারলাইন প্রাণী বহন করে না। তাই টিকেট কাটার আগে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনের নীতিমালা (Airline Pet Policy) জেনে নিতে হবে। এছাড়া আইএটিএ (IATA) অনুমোদিত বিশেষ ট্রাভেল বক্স বা ক্রেট (Travel Crate) ব্যবহার করতে হবে যেখানে প্রাণীটি স্বাচ্ছন্দ্যে নড়াচড়া করতে পারে।

আপনার একটু বাড়তি প্রস্তুতি আর সচেতনতা প্রিয় পোষা প্রাণীর ভ্রমণকে করবে নিরাপদ ও আনন্দদায়ক। |ছবি: এখন টিভি

পোষা প্রাণীর বিদেশ যাত্রা: কিছু অতিরিক্ত ও জরুরি তথ্য (Additional Essential Facts)

ভ্রমণের মাধ্যম ও নীতিমালা যাচাই (Check Travel Policy): আপনি বাস, ট্রেন, লঞ্চ নাকি বিমানে ভ্রমণ করবেন তা আগেই ঠিক করুন। প্রতিটি মাধ্যমের আলাদা 'পেট পলিসি' (Pet Policy) থাকে। অনেক বাস বা এয়ারলাইন পোষা প্রাণী অনুমতি দেয় না। আবার কেউ দিলেও কেবল কার্গোতে বা নির্দিষ্ট ওজনের মধ্যে কেবিনে নিতে দেয়। তাই টিকিট কাটার আগে অবশ্যই তাদের শর্তাবলী জেনে নিন। ব্যক্তিগত গাড়ি হলে সবচেয়ে আরামদায়ক হয়।

পেট পাসপোর্ট (Pet Passport): বিদেশের অনেক দেশে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (EU) প্রবেশ করতে হলে প্রাণীর নিজস্ব 'পেট পাসপোর্ট' লাগে। এটি মূলত প্রাণীর ভ্যাকসিনেশন কার্ড, মাইক্রোচিপ তথ্য এবং স্বাস্থ্য সনদের একটি সমন্বিত বুকলেট। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার সময় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো এটি তৈরি করতে সহায়তা করে।

আরও পড়ুন:

এয়ারলাইন চার্জ ও কার্গো নীতি (Airline Charges & Cargo Policy): বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ অধিকাংশ এয়ারলাইনে পোষা প্রাণী ফ্রি ব্যাগেজ হিসেবে গণ্য হয় না। একে 'এক্সেস ব্যাগেজ' হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ওজন অনুযায়ী এর খরচ সাধারণত ১০০ ডলার থেকে ৩০০ ডলার (১১,০০০ - ৩৫,০০০ টাকা) পর্যন্ত হতে পারে। প্রাণীর ওজন ৮-১০ কেজির বেশি হলে তাকে কেবিনের পরিবর্তে বিমানের বিশেষ কার্গো হোল্ডে (Cargo Hold) পাঠাতে হয়, যেখানে তাপমাত্রা ও অক্সিজেন কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

যাত্রার আগে খাবারের নিয়ম (Pre-flight Feeding): ভ্রমণের অন্তত ৫ ঘণ্টা আগে প্রাণীকে খাবার দেওয়া বন্ধ করতে হবে, যাতে উড়োজাহাজে সে অসুস্থ না হয়ে পড়ে। তবে পানির পাত্র ক্রেটের সাথে সংযুক্ত রাখতে হবে যাতে সে তৃষ্ণার্ত না থাকে।

সরকারি ফি ও সময় (Government Fees & Timeline): প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে এনওসি (NOC) বা অনাপত্তি পত্র নিতে সরকারি খরচ প্রায় ৫৭৫ টাকা। তবে পুরো প্রসেসটি (ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে টিটার টেস্ট) সম্পন্ন করতে অন্তত ৩ থেকে ৪ মাস সময় হাতে রাখা উচিত।

কোয়ারেন্টাইন নিয়ম (Quarantine Rules): গন্তব্য দেশে পৌঁছানোর পর কিছু দেশ (যেমন: যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়া) প্রাণীকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সরকারি কোয়ারেন্টাইনে রাখতে পারে। দেশভেদে এই নিয়ম ভিন্ন হয়।

আরামদায়ক ক্যারিয়ার বা ব্যাগ (Comfortable Pet Carrier): বিড়াল বা ছোট জাতের কুকুরের জন্য আইএটিএ (IATA) অনুমোদিত একটি মজবুত ও আরামদায়ক ট্রাভেল ব্যাগ বা ক্রেট কিনুন। ব্যাগটি এমন হতে হবে যেন প্রাণীটি অনায়াসে দাঁড়াতে, বসতে এবং ঘুরতে পারে। এতে করে সে সুরক্ষিত বোধ করবে।

আরও পড়ুন:

পরিচিত পরিবেশের আবহ তৈরি (Familiar Items): নতুন পরিবেশে প্রাণীরা সহজেই ঘাবড়ে যায়। তাই তাদের পরিচিত খেলনা, প্রিয় কম্বল বা খাবারের বাটি সঙ্গে রাখুন। পরিচিত ঘ্রাণ ও জিনিস তাদের মানসিক চাপ বা ট্রাভেল অ্যাংজাইটি (Travel Anxiety) কমাতে সাহায্য করবে।

আইডি ট্যাগ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা (ID Tag & Safety): অপরিচিত জায়গায় প্রাণী ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারে। তাই তাদের গলার কলারের সাথে একটি আইডি ট্যাগ (ID Tag) লাগিয়ে দিন, যেখানে আপনার ফোন নম্বর লেখা থাকবে। সম্ভব হলে জিপিএস ট্র্যাকার (GPS Tracker) ব্যবহার করুন।

মানসিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ (Observe Behavioral Changes): সব প্রাণী ভ্রমণ সহ্য করতে পারে না। যদি দেখেন আপনার সঙ্গীটি অতিরিক্ত অস্থির হয়ে পড়ছে বা অসুস্থ বোধ করছে, তবে দীর্ঘ যাত্রা এড়িয়ে চলাই ভালো। তাদের শারীরিক ভাষা বুঝে সিদ্ধান্ত নিন।

প্রিয় পোষা প্রাণীকে নিয়ে ভ্রমণে যাবেন? যাত্রার আগে এই বিষয়গুলি অবশ্যই নিশ্চিত করুন |ছবি: এখন টিভি

পোষা প্রাণীকে বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি কেবল আবেগীয় নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আইনি প্রক্রিয়া। অনেক সময় দেখা যায়, সব নথিপত্র ঠিক থাকার পরেও সামান্য একটি ভুলের কারণে এয়ারপোর্ট থেকে প্রাণীকে ফেরত পাঠানো হয়। তাই ভ্রমণের অন্তত ৩-৪ মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করা বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখবেন, বিদেশের মাটিতে পৌঁছানোর পর অনেক দেশেই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রাণীকে সরকারি কোয়ারেন্টাইনে রাখা বাধ্যতামূলক হতে পারে। তাই যাওয়ার আগেই গন্তব্য দেশের 'ইমপোর্ট পলিসি' ভালোভাবে যাচাই করে নিন। সঠিক পরিকল্পনা আর ধৈর্যের মাধ্যমে আপনার প্রিয় সঙ্গীটিও হতে পারে আপনার প্রবাস জীবনের সঙ্গী।





এসআর