বিড়াল আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে, একাকীত্ব দূর করে, এমনকি শিশুদের অ্যালার্জি প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে। তবে, বিড়াল পালনে কিছু দিক খেয়াল রাখতে হয়, যেমন নিয়মিত লিটার বক্স পরিষ্কার রাখা, পশমের যত্ন নেওয়া এবং আসবাবপত্রে আঁচড়ের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা। সবকিছু বিবেচনা করে, একটি বিড়ালকে সঠিক যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে পরিবারে বরণ করে নিতে হয়।
Complete Guide to Pet Care
বিড়াল যে একটি অত্যন্ত আদুরে প্রাণী, তা অজানা নয়। বাড়ির সদস্যরা তাদের স্বভাবের মজার দিকগুলো আবিষ্কার করে বেশ আনন্দ পান। প্রতিটি বিড়ালের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হয়—কেউ হয় শান্ত ও আলসে, আবার কেউ বেশ চঞ্চল ও ছটফটে। কোনো বিড়াল আপনার কথার উত্তরে বিভিন্ন আওয়াজ করে, আবার কেউ থাকে একেবারেই চুপচাপ।
অনেকের ধারণা থাকলেও, বিড়ালের খাদ্য কেবল মাছ আর দুধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রাকৃতিকভাবে বিড়াল মাংসাশী প্রাণী, তাই তাদের খাদ্যে প্রাণিজ প্রোটিন থাকা অত্যন্ত জরুরি। মাংস, মাছ, এবং ডিম তাদের শক্তি যোগাতে, পেশি তৈরি করতে এবং মেরুদণ্ডকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। পাশাপাশি, তাদের খাবারে চর্বির সঠিক পরিমাণ থাকা চাই, যা শক্তি সরবরাহ করে এবং ভিটামিন শোষণে সহায়তা করে।
বিড়ালরা তাদের মজার খেলা, রহস্যময় দৃষ্টি এবং কোমল ঘুরঘুর শব্দে সহজেই আমাদের মন জয় করে এবং আমাদের জীবনে একটি বিশেষ স্থান করে নেয়। তবে, তাদের যত্ন সম্পর্কে জানা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিভাবে পোষা বিড়ালের যত্ন নিতে হবে সে সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক-
পোষা বিড়ালকে সুস্থ, সুখী এবং নিরাপদ রাখতে সঠিক যত্নের কোনো বিকল্প নেই। নিচে দেয়া হলো আপনার প্রিয় বিড়ালটির যত্নের বিস্তারিত দিকনির্দেশনা:
১. বিড়ালের জন্য পরিবেশ সুরক্ষা ও নিরাপত্তা
বাসা ক্যাটপ্রুফ করা: বিশেষ করে বহুতল ভবনে বসবাস করলে আপনার বাসাটি বিড়ালের জন্য সুরক্ষিত করুন। যেখান দিয়ে বিড়াল বাইরে যেতে বা নিচে পড়ে যেতে পারে (যেমন বারান্দা বা বাথরুমের জানালা), সেখানে ছোট ফাঁসের তার বা নাইলনের নেট লাগিয়ে দিন।
বিষাক্ত পদার্থ দূরে রাখুন: কখনোই তেলাপোকা বা ইঁদুরের বিষ ব্যবহার করবেন না। বিড়াল যেন কোনো প্রকার রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে না আসে, সেদিকে সতর্ক থাকুন।
২. বিড়ালের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও টিকাদান
বিড়ালের টিকাদান:
কম্বাইন্ড টিকা: বিড়ালের দুই মাস বয়সে এই টিকা দিন। এর ২১ বা ২৮তম দিনে বুস্টার ডোজ দিতে হয়।
জলাতঙ্কের টিকা: বিড়ালের তিন মাস বয়স হলে এটি দেওয়া আবশ্যক। টিকা দেওয়া থাকলে বিড়ালটি অন্য প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের শিকার হলেও নিরাপদ থাকে। টিকা দেওয়া থাকা বিড়ালের কামড় বা আঁচড়ে মানুষের জলাতঙ্কের ঝুঁকি থাকে না।
বার্ষিক টিকা: বছরে একবার বিড়ালকে টিকা দিতে হবে।
টিকা দেয়ার নিষেধাজ্ঞা: বিড়াল গর্ভাবস্থায় থাকলে কিংবা বিড়ালের দেড় মাস বা এর কম বয়সী বাচ্চা (যে মায়ের দুধ খায়) থাকলে সেই মাকে টিকা দেওয়া যাবে না।
৩. বিড়ালের সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টি
পরিষ্কার পানি: বিড়ালের জন্য পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা রাখুন এবং নিয়মিত পানি বদলে দিন। তবে তারা নির্দিষ্ট পাত্রের বদলে অন্য কোথাও থেকেও পানি খেতে আগ্রহী হতে পারে।
পাত্র ব্যবহার: উন্নত মেলামিনের পাত্রে খাবার ও পানি দিন।
পুষ্টির চাহিদা: বিড়ালের খাদ্যে আমিষ আবশ্যক। এরপর পর্যায়ক্রমে স্নেহজাতীয় ও শর্করাজাতীয় খাবারের চাহিদা রয়েছে।
খাবারের বিকল্প: চামড়া ছাড়া মুরগির মাংস সেদ্ধ, সেদ্ধ কলিজা, সেদ্ধ মাছ, ডিম, সেদ্ধ সবজি (কুমড়া, লাউ, শসা, মটর, গাজর, শিমের বিচি, ব্রকলি, মিষ্টিআলু), সেদ্ধ ভুট্টা, সেদ্ধ গম, কলা, বিচি ছাড়া তরমুজ, ব্লু-বেরি, হার্ড চিজ, কটেজ চিজ, দই দিতে পারেন।
ওট: গরম পানিতে ১০ থেকে ২০ মিনিট ওট ভিজিয়ে রেখে ডিম বা কুসুম মিশিয়ে কিছুক্ষণ রেখে খাওয়াতে পারেন।
শীতের খাবার: শীতের সময় তেলযুক্ত মাছ দেওয়া ভালো।
ঘাস রাখুন: বাড়িতে ঘাস রাখুন। প্রয়োজন হলে তারা ঘাস খেয়ে নেয়, যা বিষাক্ত পদার্থ বমি করে উগরিয়ে দিতে সাহায্য করে।
নিষিদ্ধ খাবার:
বিড়ালকে পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মাছ-মাংস বা প্রাণিজ পণ্য, আঙুর, চকলেট, চা, কফি, চিনি, এবং অ্যালকোহল খাবার দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। প্রক্রিয়াজাত করা হয়নি (আনপ্রসেসড) এমন বা তরল দুধ না দেওয়াই ভালো। তবে অভ্যাস থাকলে বা প্রয়োজনে (গুঁড়া দুধও) দেওয়া যায়। মায়ের দুধ না পেলে ছোট্ট বিড়ালকে তরল দুধের সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে পাতলা করে দিন। সম্ভব হলে শর্করাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
এছাড়া, তরল খাবার বা ওষুধ খাওয়াতে হলে তা মুখের এক পাশ থেকে দিন। মুখের মাঝ বরাবর দিলে খাবার বা পানি শ্বাসনালিতে গিয়ে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
৪. বিড়ালের পরিচ্ছন্নতা ও গ্রুমিং
গ্রুমিং
গ্রুমিং হলো বিড়ালকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রক্রিয়া, যেখানে তাদের পশম, নখ, কান, এবং দাঁতের যত্ন নেওয়া হয়। নিয়মিত গ্রুমিং করলে গন্ধ, জট বাঁধা এবং ত্বকের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। আপনি অভিজ্ঞ কারো তত্ত্বাবধানে নিজে গ্রুমিং করতে পারেন অথবা পেশাদার গ্রুমার দ্বারা করিয়ে নিতে পারেন (যা কিছুটা ব্যয়বহুল হতে পারে)।
লিটার বক্স
বিড়ালের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের মধ্যে সবার আগে পেট লিটার বক্স কেনা উচিত। এটি তাদের মল-মূত্র ত্যাগের স্থান। বিড়াল সাধারণত পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে, তাই ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা করলে লিটার বক্স ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব।
গোসল
সাধারণভাবে, বিড়ালদের প্রতি ৪ থেকে ৬ সপ্তাহে একবার গোসল করানো উচিত। তবে যদি আপনার বিড়াল বেশি বাইরে থাকে বা খুব নোংরা করে ফেলে, তবে তাদের ১ বা ২ সপ্তাহে একবার গোসল দেয়া যেতে পারে। বিড়ালকে গোসল করানোর ক্ষেত্রে-
১. গোসলের জন্য পর্যাপ্ত উষ্ণ পানি দিয়ে বালতি বা গামলা পূর্ণ করুন এবং ধীরে ধীরে বিড়ালকে বসিয়ে দিন। অতিরিক্ত পানি ভরবেন না।
২. প্রবাহিত পানির শব্দ বিড়ালকে অস্থির করতে পারে, তাই বাথরুমে আনার আগে পানি ভরা ভালো। শাওয়ার হেড ব্যবহার না করে একটি ছোট মগ ব্যবহার করা উত্তম।
৩. বাজারে বিড়ালের শ্যাম্পু কিনতে পাওয়া যায় সেগুলো ব্যবহার করুন এবং ১ অংশ শ্যাম্পু ও ৫ অংশ পানির মিশ্রণ তৈরি করুন। অ্যালার্জি পরীক্ষা করতে আগে প্যাচ টেস্ট করে নিন।
৪. গোসলের শেষে একটি বড় তোয়ালে ব্যবহার করে বিড়ালকে মুছিয়ে পেঁচিয়ে নিন। ব্লো ড্রায়ার ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে তা সর্বনিম্ন সেটিংয়ে ব্যবহার করুন, কারণ শব্দের প্রতি বিড়ালের সংবেদনশীলতা ভিন্ন হতে পারে। একটি নরম তোয়ালে দিয়ে ভালোভাবে মুছিয়ে দেওয়াই সাধারণত শ্রেয়।
৫. বিড়ালের সঙ্গে খেলাধুলা ও মানসিক সুস্থতা
খেলাধুলা ও সুস্থতা: বিড়াল খুব চঞ্চল প্রাণী এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি তাদের শিকারি প্রবৃত্তি ও মাংসপেশীকে সক্রিয় রাখে, সেইসাথে মনোযোগ বাড়ায় এবং উদ্বেগ দূর করে।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক: নিয়মিত বিড়ালের সাথে খেলাধুলা করুন। এটি তাদের সুস্বাস্থ্যের পাশাপাশি আপনার সাথে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করবে। বর্তমানে বিড়ালের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রিমিয়াম কোয়ালিটির খেলনা পাওয়া যায়।
হাঁটতে নিয়ে যাওয়া: বিড়ালকে নিয়ম করে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া উচিত। এতে তাদের শরীর ও মন ভালো থাকে।
৬. বিড়ালের আঁচড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রাখা
বিড়ালের আঁচড়ানোর আচরণটি হলো একটি সহজাত প্রবৃত্তি যা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য পূরণ করে। বিড়ালরা তাদের পায়ের গ্রন্থি থেকে গন্ধ এবং চাক্ষুষ চিহ্ন রেখে আঞ্চলিকতা চিহ্নিত করে, যা অন্যান্য প্রাণীদের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠায়। এটি তাদের পেশি প্রসারিত করার এবং নখরগুলি ধারালো ও সুস্থ রাখার জন্য একটি প্রয়োজনীয় ব্যায়াম এবং সাজসজ্জার ফর্ম।
মানসিক দিক থেকে, স্ক্র্যাচিং চাপ উপশম করতে এবং আবেগের বহিঃপ্রকাশে সাহায্য করে, বিশেষ করে পরিবেশের পরিবর্তনের সময়। এছাড়াও, মাল্টি-বিড়াল পরিবারে এটি যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে এবং যখন তারা বিরক্ত হয় তখন খেলার একটি রূপ হিসাবেও কাজ করতে পারে। ধ্বংসাত্মক আঁচড়ানো প্রতিরোধ করতে বিড়ালের এ অপরিহার্য আচরণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখা গুরুত্বপূর্ণ। বিড়ালের আঁচড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রাখা দরকার বাসায়।





