বিভিন্ন কারণে ক্লান্তির অনুভূতি হতে পারে। তবে এর মধ্যে যে কারণগুলো বেশিরভাগের ক্ষেত্রে মিলে যায় সেগুলো তুলে ধরা হলো।
জীবনযাত্রার কারণ
ঘুমের অনিয়ম বা অপর্যাপ্ততা: সুস্থতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হচ্ছে ঘুম। পরিমিত ঘুম মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দূর করে। কেননা প্রতিদিন মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সচল থাকে ও বিভিন্ন কাজ করতে থাকে। সারাদিনের এসব কাজের পর শরীরের অঙ্গগুলোর বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এ বিশ্রাম আসে ঘুম থেকে। তবে প্রতিদিন যদি পর্যাপ্ত ঘুম না হয়, তাহলে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পুনরায় কাজ করার জন্য উদ্যম ফিরে পায় না এবং এতে অবসাদের সৃষ্টি হয়।
মানসিক চাপ: আমরা চলার পথে বিভিন্ন বিষয়ের সম্মুখীন হয়ে থাকি। এর মধ্যে কিছু বিষয় আমাদের মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ মানসিক চাপ দীর্ঘ সময়ব্যাপী স্থায় হলে তা আমাদের মানসিক অবসাদ বা দুর্বলতা তৈরি করে। এর ফলে কাজের প্রতি আমাদের অনীহা আসে এবং শারীরিক অবসাদও সৃষ্টি হয়।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: সঠিক পুষ্টির অভাব বা ভারসাম্যহীন ডায়েট ক্লান্তির কারণ হতে পারে। কেননা সুস্থ দেহের জন্য আরকেটি পূর্বশর্ত হলো স্বাস্থ্যকর খাবার ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস। পুষ্টিকর খাবার আমাদের শরীরকে যেমন সুস্থ রাখে, তেমনই শরীরে শক্তির যোগান দেয়। তেমনি অপুষ্টিকর খাবার বা অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের ফলে শরীরে নানা ধরনের অসুখের কারণ হতে পারে। যা শরীরকে দুর্বল করে দেয় এবং অবসাদের সৃষ্টি করে।
পানিশূন্যতা: পানি ছাড়া মানুষের জীবন কল্পনা করা যায় না। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি না পান করলে আমাদের শরীরে পানির ঘাটতি তৈরি হয়। পানি আমাদের শরীরে রক্তের প্রবাহ ঠিক রাখে। তবে যথেষ্ট পানি পান না করলে তা আমাদের শরীরকে পানিশূন্য করে তোলে এবং এতে শারীরিক অবসাদের সৃষ্টি হয়।
শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা বা নিয়মিত শরীরচর্চার অভাবেও ক্লান্তি আসতে পারে। কেননা অলস জীবনযাপন শরীরকে নিস্তেজ করে তোলে। এতে যেকোনো কাজে শরীর দ্রুত হাঁপিয়ে ওঠে।
স্বাস্থ্যগত কারণ
শরীরের অভ্যন্তরে কিছু রোগের কারণেও ক্লান্তি বা অবসাদের সৃষ্টি হতে পারে। যেমন—
অ্যানিমিয়া: শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়, যা অ্যানিমিয়া রোগ হিসেবে পরিচিত। এ রোগের কারণে শারীরিক ক্লান্তিভাব দেখা দিতে পারে।
থাইরয়েডের সমস্যা: থাইরয়েড গ্রন্থির এক ধরনের সমস্যা যাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়ে থাকে, সেই সমস্যার কারণে থাইরয়েড গ্রন্থি যথেষ্ট হরমোন তৈরি করে না। ফলে ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পারার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
ডায়াবেটিস: অনিয়ন্ত্রিত রক্তে শর্করার মাত্রা ক্লান্তি বাড়ায়। তাই যাদের ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে তাদের অল্পতেই ক্লান্ত বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি চোখে পড়ে।
হৃদরোগ: হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলরের মতো সমস্যা ক্লান্তির কারণ হতে পারে। যাদের হৃদরোগের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে সেসব রোগীদের হার্টের রক্ত পাম্প করার সক্ষমতা কমে যায়। ফলে এসব রোগী অল্পেই হাপিয়ে ওঠে, যা ক্লান্তির সৃষ্টি করে।
যকৃতের অসুখ: যকৃতের সমস্যাও শরীরকে দুর্বল করে ক্লান্তির সৃষ্টি করে। যকৃতের সমস্যায় শরীরের রেচন প্রকৃয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশন সঠিকভাবে সম্পন্ন হতে পারে না, যা শরীরে জমা হয়ে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে শরীরকে দুর্বল করে দিতে পারে।
ভিটামিনের অভাবে শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি
ভিটামিন বি১২ এবং ভিটামিন ডি এর অভাবে শরীর দুর্বল হতে পারে। তথ্যমতে, ভিটামিন বি১২ এর অভাবে শরীর শুকিয়ে যেতে পারে, কারণ এর ঘাটতি হলে পেশী দুর্বলতা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং স্নায়ুর ক্ষতি হয়ে থাকে। যা পরোক্ষভাবে ওজন হ্রাস এবং শরীর শুকিয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে। ভিটামিন বি১২ সরাসরি শরীর শুকানোর জন্য দায়ী না হলেও, এটি লোহিত রক্তকণিকা তৈরি এবং স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য।
আর ভিটামিন ডি-এর অভাবে ক্লান্তি, পেশী ব্যথা এবং দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। ভিটামিন ডি-এর অভাবের প্রধান কারণ হলো সূর্যের আলো কম পাওয়া, যা শরীরকে প্রাকৃতিক ভিটামিন ডি তৈরি করতে বাধা দেয়। এছাড়াও খাদ্যতালিকায় ভিটামিন ডি-যুক্ত খাবারের অভাব এবং কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণেও এ ভিটামিনের অভাব হতে পারে। যেমন- লিভার বা কিডনির রোগ, যা ভিটামিন ডি-এর শোষণ বা বিপাককে ব্যহত করে।
দুর্বলতা কমাতে এবং শক্তি বাড়াতে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, হাড় ও পেশীর দুর্বলতা কাটাতে ভিটামিন ডি এবং ক্লান্তি দূর করতে ভিটামিন সি গুরুত্বপূর্ণ। তবে যেকোনো ভিটামিন ওষুধ সেবনের আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত, কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করলে তা শরীরের ক্ষতি করতে পারে।
এছাড়া দুর্বলতা কাটাতে স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন ফল, সবজি, এবং আস্ত শস্যদানা খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম এবং পরিমিত জল পান করা সহায়ক হতে পারে।
শরীর দুর্বল হলে যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারে
শারীরিক দুর্বলতার কারণে ক্লান্তি, পেশীর দুর্বলতা এবং মাথা ঘোরার মতো সমস্যাসহ আরও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। দুর্বলতার ফলে দৈনন্দিন কাজ করতে অসুবিধা হয়, মনোযোগ কমে যেতে যায় এবং মেজাজ খিটখিটে হয়। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, এটি একটি নির্দিষ্ট পেশীর দুর্বলতা বা অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ। তাই দীর্ঘস্থায়ী যেকোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে প্রথমেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
শরীর দুর্বলতার লক্ষণ: শরীর দুর্বলতার সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো— রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি, পেশীর দুর্বলতা বা ব্যথা এবং মাথা ঘোরা। এর সঙ্গে দৈনন্দিন কাজ করতে অসুবিধা হওয়া, পেশীতে টান ধরা বা খিঁচুনি এবং সীমিত নড়াচড়ার অক্ষমতাও দেখা দিতে পারে।
খাবার খাওয়ার পর দুর্বলতা বা ক্লান্তিভাব
খাবার খাওয়ার পর অনেকেরই দুর্বলতা অনুভূত হয়ে থাকে। এরকম দুর্বলতার কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হলো রক্তে শর্করার ওঠানামা, হজম প্রক্রিয়া সমস্যা এবং যথাযথ পুষ্টির অভাব। ভাত, রুটি, চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলো খুব দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে রক্তে গ্লুকোজ দ্রুত কমে যায়। এর ফলে হঠাৎ করে দুর্বল লাগা, মাথা ঝিমঝিম করা এবং মনোযোগের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
এছাড়া ভারী খাবার খাওয়ার পর হজমের জন্য শরীরের স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি শক্তি ও রক্ত প্রবাহ পাকস্থলীতে প্রয়োজন হয়। এর প্রভাবে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ খানিকটা কমে যায়। এতেও শরীরে ক্লান্তি ও অবসাদের অনুভূতি তৈরি করে।
ঘুম থেকে ওঠার পর ক্লান্তি বা শারীরিক দুর্বলতা
আমাদের মধ্যে অনেকেরই ঘুম থেকে ওঠার পর ক্লান্ত লাগে, দুর্বলতা অনুভূত হয়। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন— পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, পানিশূন্যতা, মানসিক চাপ অথবা ঘুমের অনিয়ম। এছাড়া পর্যাপ্ত ব্যায়াম না করা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং ঘুমের জড়তার (sleep inertia) কারণেও এমনটা হতে পারে।





