পরিবেশ ও জলবায়ু
0

প্রাণীশূণ্য ৪০ কিলোমিটার বনভূমি

নেত্রকোণায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাহাড় ও বনভূমি থাকলেও নেই তেমন বন্যপ্রাণী। অপরিকল্পিত বনায়ন, বনভূমি ধ্বংস করায় আবাসস্থল হারাচ্ছে বন্যপ্রাণীরা। যার প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর। এছাড়া সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী কমায় চাষের জমিতে বাড়ছে পোকামাকড়ের উপদ্রব।

ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষে সীমান্তবর্তী অঞ্চল নেত্রকোণা। জেলার দুইটি উপজেলা দুর্গাপুর ও কলমাকান্দাকে ঘিরে রেখেছে নদী, পাহাড় ও বনভূমি।

পাহাড়ি এই অঞ্চলে বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। পাহাড় ঘিরেই জীবিকা স্থানীয় মাসুদ মিয়ার। ৪০ বছর ধরে বনের উপর নির্ভর করে বড় হয়েছেন তিনি। নিজের চোখে দেখেছেন বনের বদলে যাওয়ার দৃশ্য। আগে বাঘ, হরিণসহ নানা বন্যপ্রাণী থাকলেও এখন তেমন দেখে মেলে না। অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটায় কমেছে বনের ঘনত্ব। এছাড়া ফসলি জমির ফলন কমে ভাটা পড়েছে আয়ে।

মাসুদ মিয়া বলেন, 'আগে আমরা অনেক হাতি, বানর, হরিণ দেখেছি কিন্তু  এখন এইসবের কিছু দেখা যায় না।'

আশপাশের পাহাড়গুলোতে একসময় বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ থাকলেও এই সংখ্যা এখন শূণ্যের কোটায়। গত ২৫ বছরে গাছ নিধনসহ বনভূমি ধ্বংসের ফলে বিলুপ্ত হয়েছে এই অঞ্চলের অন্তত ৬০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী।

সীমান্তবর্তী প্রায় ৪০ কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকাজুড়ে একসময় বনে মায়া হরিণ, ভাল্লুক, বাঘ, কয়েক প্রজাতির বানরসহ অসংখ্য প্রাণীর বিচরণ থাকলেও এখন সবকিছুই স্মৃতি। হরিণের জন্য এই এলাকা বেশ প্রসিদ্ধ হলেও গত ২৫ বছরে একটি হরিণেরও দেখা পায়নি স্থানীয়রা। তেমনি বনমোরগ, মেছো বিড়াল, নানারকম বানর বিলুপ্ত হয়েছে। বনের উঁচু গাছ কেটে এখন রোপন করা হয়েছে বিদেশি গাছ।

এদিকে, খাদ্য সংকটে বারবার লোকালয়ে চলে যাচ্ছে বনের সব প্রাণী। বারবার বুনো হাতির দল ঢুকে পড়ছে মানুষের বাড়িঘরে। একদিকে, যেমন ক্ষতিগ্রস্ত বসতভিটা তেমনি আহত ও নিহতের ঘটনাও ঘটছে। গতবছর দুর্গাপুর ও কলমাকান্দার পাঁচগাঁও সীমান্তে বুনো হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যান দুজন কৃষক। গত পাঁচ বছরে এই অঞ্চলে প্রাণ হারিয়েছে চারটি বুনো হাতি।

পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তথ্য বলছে, গত তিন বছরের ৪৫টি রেসকিউ অপারেশনের মাধ্যমে শতাধিক বন্যপ্রাণী উদ্ধার হয়েছে। যার সবকয়টি চিকিৎসার পর অবমুক্ত করা হয়েছে বনে।

স্বেচ্ছাসেবক সুশান্ত প্রসাদ বলেন, 'বন্যপ্রাণীকে বনে রাখতে চাই এবং তাদের ভালো পরিবেশ দিতে চাই। সবাইকে সবার জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে।'

বন্যপ্রাণী কমায় প্রভাব পড়েছে পরিবেশের উপর। পাহাড়ি অঞ্চলে বছরে আউশ, আমন, বোরো তিনটি ফসলের উৎপাদন হয়। তবে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী কমায় জমিতে বাড়ছে পোকামাকড় ও ইঁদুরের উপদ্রব। কৃষকরা জানান, আগে প্রাকৃতিকভাবে এগুলো নিয়ন্ত্রণ হলেও এখন নানারকম ফাঁদ, ওষুধ, কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ছে। 

এদিকে বন্যপ্রাণী রক্ষায় পাহাড়ি বনভূমিতে ফলের গাছ রোপনসহ প্রশাসনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান পরিবেশ কর্মীরা।

সুসং সরকারি মহাবিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক সুফিয়া আক্তার বলেন, 'পাহাড়ি এলাকায় যদি ফলজ জাতীয় গাছ লাগানো হয় এবং আগাছা পরিস্কার করে বন্যপ্রাণীর জন্য ব্যবস্থা করা হয় তাহলে বন্যপ্রাণী বাঁচবে।'

সেভ দ্য এনিমেলস অফ সুসংয়ের উপদেষ্টা একেএম ইয়াহিয়া বলেন, 'আবারও যদি বনকে বাঁচতে চাই এবং বনের প্রাণিগুলোকে বাঁচতে চাই তাহলে আমাদের সেই বনায়নের পথে ফিরে আসতে হবে।'

বনভূমি রক্ষায় গাছ রোপনসহ বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নেত্রকোণার জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ। তিনি বলেন, 'বন্যপ্রাণীর হাতে মানুষের জানমালের কোনো ক্ষতি না হয় বা বন্যপ্রাণী স্বাভাবিক ভাবে বনে থাকতে পারে এই বিষয়ে প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে।'

শুধু গাছপালা নিধনই নয় গহীন বনে বনভোজনের নামে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ও প্লাস্টিক পণ্য ফেলে রাখায় নষ্ট হচ্ছে বনের পরিবেশ।

ইএ

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর