অভিযোগ রয়েছে যোগসাজশের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ পাচার ও ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে এমন পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসান ইমাম।
তাকে এ কাজে সহযোগিতা করছেন তারই প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ পদে থাকে তিন ব্যক্তি। ওই তিন ব্যক্তিই আবার রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ট্রাস্ট্রি প্রতিষ্ঠান বিজিআইসির মনোনীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্টরা।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বা তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান যদি এক বা একাধিক ব্যক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে তাহলে সেখানে অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বিশেষ করে মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে অর্থ নয়ছয় করার বড় সুযোগ থাকে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মিউচুয়াল ফান্ড খাতের স্বচ্ছতা বাড়াতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) আরো কঠোর হতে হবে।
ইতোমধ্যে রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, যাতে তাদের বিনিয়োগ না হারাতে হয়।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতে, এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পিকে হালদারের মালিকানাধীন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের মতো হতে পারে রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পিএলসি।
জানা গেছে, হাসান ইমামের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি তিনটি হলো- ডাটাসফট সিস্টেমস বাংলাদেশ লিমিটেড, ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট স্টেপস লিমিটেড ও একাশিয়া শ্রিম লিমিটেড।
এছাড়া বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ট্রাস্ট্রি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্সকেও হাসান ইমাম সুপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। বিশেষ করে বিজিআইসির পরিচালনা পর্ষদে মনোনীত পরিচালক হিসেবে এমন তিনজন ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করছেন, যারা হাসান ইমামের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির শীর্ষ পদে রয়েছেন। ওই তিন ব্যক্তি হলেন- অরুণাংশু দত্ত, মোহাম্মদ মুনজুর মাহমুদ ও কায়সার ইসলাম।
এর মধ্যে অরুণাংশু দত্ত একাশিয়া শ্রিম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), মোহাম্মদ মুনজুর মাহমুদ ডাটাসফট সিস্টেমস বাংলাদেশ লিমিটেড ঢাকার প্রেসিডেন্ট ও কায়সার ইসলাম ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট স্টেপস লিমিটেড ঢাকার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আর এই তিনটি কোম্পানির মালিকানায় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রয়েছেন হাসান ইমাম। পুঁজিবাজার থেকে বিশেষ সুবিধা নিতেই সুপরিকল্পিতভাবে রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ও ট্রাস্ট্রি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন হাসান ইমাম। আর তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করছেন অরুণাংশু দত্ত, মোহাম্মদ মুনজুর মাহমুদ ও কায়সার ইসলাম।
বিএসইসির মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা সুপরিকল্পিতভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তাই পুঁজিবাজারের মিউচুয়াল ফান্ড খাতের উন্নয়নে এ ধরনের আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ড রোধ করতে বিএসইসিকে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্টরা।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০০১ এর বিধি ১৯(১)(ঘ) উল্লেখ রয়েছে-‘নিবন্ধন মঞ্জুরীর জন্য অযোগ্যতা- কোন কোম্পানি, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ট্রাস্টি হিসাবে নিবন্ধন মঞ্জুরীর জন্য যোগ্য হইবে না যদি- উহা বা উহার কোন পরিচালক কোন মিউচুয়াল ফান্ডের উদ্যোক্তা বা সম্পদ ব্যবস্থাপক, স্টক ডিলার, স্টক ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংকার ও পোর্টফোলিও ম্যানেজার হন বা উহার বা উহাদের অধীন কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কোন পরিচালক হন বা উহার সহিত কোন ভাবে সম্পর্কিত হন।’
এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের মিউচুয়াল ফান্ড খাত বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। সুশাসন ও স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকায় খাতটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। সম্প্রতি এক সম্পদ ব্যবস্থাপক অর্থ আত্মসাৎ করে দুবাইয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আবারো সামনে এসেছে এ খাতের দুর্দশার চিত্র।
এ অবস্থায় মিউচুয়াল ফান্ড খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের কার্যক্রম পরিদর্শনের মাধ্যমে সম্পদ যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয় বিএসইসি।
সম্পদ যাচাই শেষে বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্টের সিইও এবং এমডি হাসান ইমামের বিরুদ্ধে অর্থপাচারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। এরই অংশ হিসেবে রেস পরিচালিত ফান্ডগুলোর অবস্থা খতিয়ে দখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি।
তদন্ত চলাকালীন এসব ফান্ড থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ যেন না থাকে, সে লক্ষ্যে বিএসইসির পক্ষ থেকে রেস ও তার ফান্ডগুলোর সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার জন্য বিএফআইইউকে চিঠি দেওয়া হয়।
ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের গত ১০ জুন বিএফআইইউ ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে। একইসঙ্গে গত ২৫ জুন রেইস ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সকল ফান্ডের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেছে বিএসইসি।
এ বিষয়ে বিএসইসির কমিশনার ড. এটিএম তারিকুজ্জামান এখন টিভিকে বলেন, ‘সবার জন্য আইন সমান। এটা বাস্তবায়নে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এখন থেকে শেয়ারবাজারে আর দুর্নীতি চলবে না। অনিয়ম আর চলবে না। পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডে কিছু কিছু অনিয়ম হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মিউচুয়াল ফান্ড সংক্রান্ত আইন বা বিধি-বিধানের ক্ষেত্রের বৈষম্যতা ছিল। আগামীতে সেই বৈষম্য আমরা দূর করার চেষ্টা করব। সেই বৈষম্যমূলক আইন ও বিধি-বিধানগুলো রিভিউ করা হবে। মিউচুয়াল ফান্ডে যেসব বৈষমতা হয়েছে আমরা তা চিহ্নিত করে সমাধান করব।’
বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের পরিচালিত ফান্ডগুলো হলো- এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ইবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ইবিএল এনআরবি মিউচুয়াল ফান্ড, এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ফার্স্ট বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড, আইএফআইসি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, পিএইচপি ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, রেস স্পেশাল অপরচুনিটিস ইউনিট ফান্ড, ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ফার্স্ট জনতা ব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ড এবং রেস ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুসন ইউনিট ফান্ড।
উল্লেখ্য, এর আগে মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ নিয়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল ফিন্যান্সিয়াল সলিউশনস ও অ্যালায়েন্স ক্যাপিটালের কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।