পণ্য কার আমার না তোমার? এই ইস্যুতে একটার পর একটা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ-ভারত। টাঙ্গাইল শাড়ি আর সুন্দরবনের মধুর স্বত্ব নিজেদের বলে ভারত দাবি করার পর হঠাৎ করেই সরব বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়। তড়িঘড়ি করে টাঙ্গাইল শাড়িসহ, যশোরের খেজুর গুড়, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা ও লটকন এবং রাজশাহীর মিষ্টি পান জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দেয়। এর ৫ দিন পর মৌলভীবাজারের আগর, মৌলভীবাজারের আতর, রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম, মুক্তাগাছার মণ্ডা মোট ৪ টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর জানায়, জিআই পণ্যের শর্তপূরণ করে এমন পণ্যের আবেদন করার জন্য জেলা পর্যায়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পেমেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. শামীমুল হক বলেন, 'নিজ নিজ এলাকার যে ঐতিহ্যবাহী পণ্য আছে সেগুলোকে নির্ধারিত ফর্মে তথ্য দিয়ে আবেদন করার জন্য বলা হয়েছে। আবেদন পাওয়ার পর আমরা এগুলোকে অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।'

ভৌগলিক দিক থেকে বাংলাদেশ আর ভারতের মিল থাকায় দু'দেশের মধ্যে জিআই পণ্যের দ্বন্দ্ব বেশ পুরানো। এর আগে, জামদানি শাড়িও তারা তাদের জিআই পণ্য হিসেবে দাবি করে।
বাংলাদেশের প্রথম জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন বা জিআই পণ্য হিসেবে ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পায় জামদানি। তারপর ২১টি পণ্য জিআই অন্তর্ভূক্ত হয়। সেগুলো হলো ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম, ঢাকাই মসলিন, বিজয়পুরের সাদামাটি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, বাংলাদেশের কালোজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহীর সিল্ক, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের শীতলপাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসীমালা, চাপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা।
যদিও অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত পণ্য হাতে গোনা। ডব্লিউআইপিও'র তথ্যানুযায়ী ২০১৮ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত দেশ হলো জার্মানি, ১৫ হাজার ৫৬৬টি পণ্য নিয়ে শীর্ষে দেশটি। দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে চীনের জিআই পণ্য ৭ হাজার ২৪৭টি। তৃতীয় হাঙ্গেরি, জিআই পণ্য ৬ হাজার ৬৮৩টি। আর প্রতিবেশি দেশ ভারতের জিআই পণ্য রয়েছে চার শতাধিক । এর মধ্যে কৃষি পণ্যই ১৫০টির বেশি। ভারত জিআই পণ্যের সুযোগ নিয়ে রপ্তানি বাড়িয়েছে।

বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জানালেন আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে এখনো ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির মেধাস্বত্ব ফিরে পেতে পারে বাংলাদেশ। তার জন্য ভারতের আদালতে করতে হবে মামলা এবং গঠন করতে হবে টাস্কফোর্স।
বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'যে সময়ে আমাদের আপত্তি দেয়া প্রয়োজন ছিলো তখন আমরা আপত্তি দেইনি। এই জন্য এই পরিস্থিতি হয়েছে। জনগণের প্রতিক্রিয়া থেকে সরকার বুঝতে পেরেছে যে এখানে তাদের একটা গাফিলতি হয়ে গেছে। সেটা কাটানোর জন্য তারা খুব দ্রুততার সাথে এগুনোর চেষ্টা করছে। আর দ্রুততার সাথে এগুতে গিয়ে প্রচলিত পদক্ষেপ তারা পরিপালন করছে না বলে মনে হয়।'
যেসব পণ্য বাংলাদেশ ও ভারত উভয় অংশে উৎপন্ন হয় সেসব পণ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং একচ্ছত্র অধিকার দাবী বন্ধ করতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ভৌগলিক নির্দেশক কমিশন গঠনের পরামর্শ গবেষকদের।
গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, 'বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ভৌগলিক পণ্য কমিশন গঠন করার মাধ্যমে উভয় রাষ্ট্র তাদের আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কৃতির প্রকৃতি যেন সুরক্ষিত করে। কোন ভূগোলে পণ্যটি বিকশিত হয়েছে তার প্রমাণ হাজির করে আমাদের কাজ করা জরুরি।'

ডিপিডিটি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জামালপুরের নকশীকাঁথা, মধুপুরের আনারস, সুন্দরবনের মধু, শেরপুরের ছানার পায়েশ, ভোলার মহিষের কাঁচা দুধ, নওগাঁ'র নাগ ফজলি আম পণ্যগুলো জিআই এর জন্য আবেদন জমা পড়েছে যার মধ্যে যেগুলো বাংলার সংস্কৃতি বহন করে। লোক সংস্কৃতি গবেষকরা মনে করেন জাতীয় পর্যায়ে এসব পণ্যকে তুলে ধরতে এবং মেধাস্বত্ব রক্ষায় বাংলা একাডেমি এবং শিল্পকলা একাডেমি অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
লোক সংস্কৃতি গবেষক আমিনুর রহমান সুলতান বলেন, 'সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নিলে এর দায়িত্বটা বাংলা একাডেমি এবং শিল্পকলা একাডেমির ঘাড়েই পড়ে। তারা এগিয়ে আসলে চিআই পণ্যগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারবে। এতে মানুষও সচেতন হতে পারবে। তার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জাতীয় পর্যায়ে একটা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।'
বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হলে জিআইসহ অন্যান্য কপিরাইটের ব্যাপারে কড়াকড়িভাবে আইন মানতে হবে। তা না হলে কেবল স্বত্ব নেয়াই সার হবে, রপ্তানি বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিতে কাজে লাগানো যাবে না।