বিশেষ প্রতিবেদন , ব্যাংকপাড়া
অর্থনীতি
0

রাজনৈতিক ইন্ধন ও প্রশ্রয় বন্ধ না হলে ব্যাংক খাতের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোসহ তারল্য সংকটে পড়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। যার প্রভাবে ২০২৪ সালের শেষে এসেও জর্জরিত হতে দেখা যায় ব্যাংক খাতকে। বিগত সরকার এ খাতের সমস্যাগুলো আমলে না নেয়াকেই দায়ী করছেন ব্যাংকাররা। আর গেল ১৫ বছরে রাজনৈতিক যে ইন্ধন ও প্রশ্রয় ছিল- তা বন্ধ না হলে ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয় বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে যে সংস্কার শুরু হয়েছে; তার প্রতিফলন চলতি বছরে দেখা যাবে বলে জানান অর্থনীতিবিদরা।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পতনের পর এস আলমের দখলে থাকা ছয় ইসলামী ব্যাংক সহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়ে। এতে ব্যাংক ভাঙচুর ও কর্মকর্তাকে মারধরের মত ঘটনাও ঘটে। এই কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ অনিয়ম আর জালিয়াতি প্রকাশ্যে এলে পুরো ব্যাংকিং খাতই আস্থার সংকটে পড়ে। যা বিগত সময়ে নয়ছয়ের মাধ্যমে গোপন রাখা হয়েছে।

২০২৪ সালে ব্যাংকগুলোর তারল্য ঘাটতি, মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, অপরিকল্পিত একীভূতকরণ ও খেলাপি রেকর্ড বেড়ে যায়।

এছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপ থাকলেও ২০২৩ সাল শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচ ইসলামি ব্যাংকসহ সাত ব্যাংককে ২২ হাজার কোটি টাকা দেয়। এরপর জানুয়ারিতে সার-বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে সরকার যে স্পেশাল পারপাস ট্রেজারি বন্ড ছেড়েছিল, এর বিপরীতে ছয় ব্যাংককে ১২ হাজার কোটি টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপরও যখন ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়ায়নি তখন নানা সমালোচনার মাঝেও আমানতকারীদের সুরক্ষায় গত নভেম্বরে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেয় সংস্থাটি।

বিগত সরকারের নির্দেশনায় তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেয়। ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরা নগদ টাকা তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়লে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাতিল হয়ে যায় একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত।

বিগত সরকার ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে ২০২০ সালে ছয় নয় সুদ হার বাস্তবায়ন করে। তবে গত মে মাসে আইএমএফের শর্ত পূরণের বাজারে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

শেখ হাসিনা সরকার পুনঃতফসিল ও ঋণ অবলোপিত করে খেলাপিদের যে সুবিধা দিয়ে আসছিল তা বন্ধ হলে সবশেষ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। আর বিগত সময়ের গোপন করা ঋণ সামনে আসলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা।

সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোয় ফরেনসিক অডিট, পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি।

এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও আরামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও অন্যান্য আর্থিক জালিয়াতি তদন্তে সরকারি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।

বিগত সরকার রাজনৈতিক নানা ইন্ধন ও প্রশ্রয়ের কারণে এ খাতের ক্ষতির কোনো কথা আমলে নেয়নি বলে জানান এই ব্যাংকার।

ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস চেয়ারপার্সন ফারুক মইনউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে আইন পরিবর্তন বা প্রয়োগ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এগুলোকে কখনোই আমলে নেয়া হয় নি। কারো কথাই আমলে নেয়া হয় নি। আমরা অনেক ক্ষুদ্র মানুষ। আরো অনেক দেশবরেণ্য যারা ব্যক্তিত্বরা আছেন তারাও এসব কথা বলেছেন, কথা আমলে নেয়া হয় নি। আমলে নেয়া হয় নাই, কারণ এখানে ইন্ধন ছিল প্রশ্রয় ছিল।’

অন্যদিকে যে সংস্কার শুরু হয়েছে তার প্রতিফলন চলতি বছরে দেখা যাবে বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কিছু কিছু ব্যাংকে ডিপোজিট গ্রোথ বাড়তির দিকে দেখা যায়। রেমিট্যান্সের প্রবাহ যেমন বেড়েছে ইসলামী ব্যাংকগুলো, তাদেরও তারল্যের বড় সংকট রয়েছে। সেখানে হয়তো কিছুটা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে সেখানে একটা মার্কেট সলিউশন চলে আসতে পারে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামীতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে বাঁধাহীনভাবে এ খাতের সঠিক পুনর্গঠন বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সাথে সত্য গোপন রাখার ধারাবাহিকতা বন্ধ করে আইন পরিপালন নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তারা।

এএইচ