অর্থনীতি
0

চার বছরে মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ, ঈদে বিক্রি কমেছে ৮০ শতাংশ

উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ওপর। দায় দেনা মাথায় নিয়ে চলছে নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তদের সংসার, কমছে সঞ্চয়। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত চার বছরে মূল্যস্ফীতির হার দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু মানুষের আয় স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে এই ঈদের কেনাকাটা নিয়েও তেমন উৎসাহ নেই। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি বলছে, গত ঈদের তুলনায় এবারের ঈদে বিক্রি কমেছে প্রায় ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ।

মেঘনার জলে উত্তাল ঢেউ। জল ও জালের কাব্যে লেখা হয় কত শত মানুষের আমিষ যোগানের গল্প। জোয়ার ভাটার সাথে তাল মিলিয়ে যারা সময়ের হিসেব মেলান, তাদেরকে আমরা এক শব্দে বলি জেলে। মাছের নেশায় যাদের দিবা রাতি কাটে, তা কি শুধুই নেশা! নাকি মাথায় ভর করে আছে মহাজনের দাদনের টাকা।

প্রতিদিনই রাজ্যের সকল দুশ্চিন্তা নিয়ে মেঘনাপাড়ের জেলেদের সাথে মাছ ধরতে আসেন রিপন ব্যাপারী নামের একজন। একদিকে মহাজানের দাদন পরিশোধের দায়, অন্যদিকে ছেলে মেয়ে বউ স্বজনদের তিন বেলা আহার জোগাড়ের লড়াই।

তিনি বলেন, 'হলুদ, মরিচ, চাল, পেঁয়াজ কিনলাম। আমার কাছে এখন মাত্র ২০ টাকা আছে। আমার ছেলেকে কিছু কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য নাই।'

রিপন ব্যাপরীর মতো নিম্ন আয়ের বেশিরভাগ মানুষেরই জীবন চলছে এখন দায় দেনা মাথায় নিয়ে। পবিত্র ঈদুল আজহা যখন দড়জায় কড়া নাড়ছে, তখন কেমন চলছে ঈদের বাজার। বেচাবিক্রি কি আগের মতই আছে, নাকি অলস সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর গুলিস্তান বঙ্গবাজারের এনেক্স টাওয়ার। প্রতিদিনই এখানে শত কোটি টাকার উপরে টালি খাতায় হিসাব মেলান পাইকার ব্যবসায়ীরা। সাধারণত ঈদুল ফিতরের চেয়ে ঈদুল আজহায় বেচাকেনা একটু কমই হয়ে থাকে। কিন্তু, তাই বলে কতটা কম?

একজন ব্যবসায়ী বলেন, 'আজকে আমার দোকানে ২ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। যেখানে আমাদের পাইকারিই বিক্রি হয় ২ থেকে ৪ লাখ টাকা।'

অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, 'গতবছর যেখানে ১০০ টাকা বিক্রি করেছি, এবার ৪০ টাকা বিক্রি করতে পারছি। বেচাকেনা খুবই খারাপ।'

ক্রেতাশূন্য রাজধানীর নিউমার্কেট। ছবি: এখন টিভি

ঈদের খুচরা বাজার রাজধানীর নিউমার্কেট। গত দুইদিনের নিউমার্কেটের চিত্র জানান দেয়, কতটা খারাপ সময় যাচ্ছে মানুষের। ঈদের ঠিক আগমুহূর্তে ক্রেতাবিহীন মার্কেট শেষ কবে দেখেছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা? তারা বলছেন, গত বছর এই সময়ে ঈদের কেনাকাটা ছিল পুরোদমে। ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে দোকানিদের। কিন্তু এ বছর বিক্রি নাটকীয়ভাবে কমেছে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, আগে আমাদের বেচকেনা হতো ২ লাখ টাকা। আর এখন হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। মানুষের আগের মতো অর্থ নাই। তাই কেনাকাটা করতে পারছে না।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, 'ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদেরর সারাদেশে ৫৬ লাখ ছোট-বড় দোকানে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনার বাজার। সেখানে ৫ ভাগের একভাগও ওঠে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। বাজারগুলো একদম ফাঁকা।'

তাহলে কি মানুষ কোরবানির হাটে গরু কেনা বেঁচায় ব্যস্ত? রাজধানীর কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, ঠিক জমে উঠছে না এবার। এখানে এমন অনেকেই এসেছেন, একসময় যারা একা একটি পশু কোরবানি দিতেন। কিন্তু এখন অভাবের বাজারে কয়েকজন শরীকে কোরবানি দেয়া ছাড়া উপায় মিলছে না তাদের।

ঈদ বাজার কিংবা পশুর হাটে যখন বেচাবিক্রির এই অবস্থা, তখন মানুষের দৃষ্টি মূলত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দিকেই। ঘুরে ঘুরে দাম দেখছেন, কিন্তু কিনছেন না। ফল দোকানগুলোর সামনে গেলে এমন দৃশ্য এখন চোখে পড়বে হরহামেশাই।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই কালে মানুষের আয়ের পরিধি খুব একটা বাড়ছে না। ক্রয় ক্ষমতার উপর পড়ছে তাই নেতিবাচক প্রভাব।

বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত চার বছরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু সেখানে এই চার বছরে মজুরি বেড়েছে মাত্র এক শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, আদর্শ অর্থনীতিতে মজুরি বৃদ্ধির হার হতে হবে মূল্যস্ফীতির তুলনায় কমপক্ষে দুই থেকে ৩ শতাংশ বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র পুরোপুরি উল্টো।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'একদিকে আয়ের বৈষম্য। অন্যদিকে নাজুক অর্থনীতি। সবমিলিয়ে নাভিশ্বাসে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমছে।'

তাই আপাতত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নজর দিতে হবে সরকারকে। সেই সঙ্গে নিম্নমুখী রিজার্ভের গতি ফেরাতে হবে আস্থাশীলতার দিকে। এমন পরমার্শই দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।