নারায়ণগঞ্জে অভ্যুত্থানের পনের মাসেও উদ্ধার হয়নি পুলিশের লুট হওয়া ৪০ অস্ত্র-গুলি

সংঘর্ষের সময় অস্ত্র হাতে
সংঘর্ষের সময় অস্ত্র হাতে | ছবি: এখন টিভি
2

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পনেরো মাস কেটে গেলেও নারায়ণগঞ্জের পুলিশ লাইন্স, সিদ্ধিরগঞ্জ ও আড়াইহাজার থানাসহ দুটি তদন্ত কেন্দ্র থেকে নিখোঁজ হওয়া অস্ত্র ও গুলির মধ্যে ৪০টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গুলি এখনো উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ চরম আতঙ্কে রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ নগরীর বিশিষ্টজনেরা বলছেন এসব অস্ত্র উদ্ধার না হলে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।

এদিকে গত এক বছরে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও গুলির ঘটনায় জনমনে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে । লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ পুরস্কার ঘোষণা করলেও তেমন কোনো সুফল এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সূত্রমতে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় নারায়ণগঞ্জের পুলিশ লাইন্স, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ও আড়াইহাজার থানাসহ দুটি তদন্ত কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়। হামলা পুলিশের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি লুট করা হয়। যার মধ্যে এখনও নিখোঁজ রয়েছে ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৭ হাজার ৩৯৫ রাউন্ড গুলি। গত বছরের ৫ আগস্ট আন্দোলনের সময় পুলিশ লাইন্স, আড়াইহাজার ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এবং দুটি তদন্ত কেন্দ্রে হামলা চালানোর পাশাপাশি অগ্নিসংযোগও করা হয়।

এসময় ১৫১টি অস্ত্র ও ৯ হাজার ২৫ রাউন্ড গুলি লুট হয়। তবে পুলিশ ও র‌্যাব ১১০টি অস্ত্র ও ১ হাজার ৫০৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে।

জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আড়াইহাজার থানার গোপালদী ও কালাপাহাড়িয়া তদন্ত কেন্দ্র থেকে লুট হয় ১৩৭টি অস্ত্র ও ৬ হাজার ১১৯ রাউন্ড গুলি। এর মধ্যে এখনও নিখোঁজ রয়েছে ২৯টি অস্ত্র ও ৪ হাজার ৮০০ রাউন্ড গুলি। হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে তিনটি ৭.৬২ (চায়না) রাইফেল, একটি ৭.৬২ (চায়না) এসএমজি, চারটি ৭.৬২ (চায়না) পিস্তল, পাঁচটি ৯এমএম পিস্তল, ১২টি ১২ বোর শর্টগান এবং চারটি ৩৮ এমএম গ্যাসগান।

আরও পড়ুন:

সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হামলায় লুট হয় পাঁচটি অস্ত্র ও ১ হাজার ৪৮৭ রাউন্ড গুলি। উদ্ধার হয়েছে মাত্র দুটি অস্ত্র ও ৪৮ রাউন্ড গুলি। বাকি তিনটি অস্ত্র ও ১ হাজার ৪৩৯ রাউন্ড গুলি এখনও নিখোঁজ। এগুলোর মধ্যে একটি ৭.৬২ (চায়না) রাইফেল ও দুটি ৯এমএম পিস্তল রয়েছে।

জেলা পুলিশ লাইন্স থেকে লুট হয় ৯টি অস্ত্র ও ১ হাজার ৪১৯ রাউন্ড গুলি। এখানকার কোনো অস্ত্রই উদ্ধার হয়নি। অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- চারটি ৭.৬২ (চায়না) রাইফেল, একটি ৭.৬২ (চায়না) এলএমজি এবং ৪টি ১২ বোর শর্টগান।

নিখোঁজ গুলির সংখ্যা ১ হাজার ২৭৯ রাউন্ড। অস্ত্রগুলো কোথায় আছে বা কারা ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এদিকে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে নারায়ণগঞ্জে প্রকাশ্যে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও গুলি চালানোর একের পর এক ঘটনায় বাড়াচ্ছে উদ্বেগ। এসব ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেলেও এখনো পর্যন্ত কোনো ঘটনার অস্ত্র উদ্ধার কিংবা অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নগরবাসীর শঙ্কা আরও গভীর হচ্ছে। স্থানীয়দের মতে, সব নির্বাচনে কিছু অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ঝুঁকি আরও বেশি। প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার পরও অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া এবং অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় বাড়ছে জনমনে আতঙ্ক।

গতবছরের ৫ আগস্টের পর নারায়ণগঞ্জের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে পরিবহন দখলকে কেন্দ্র করে দুই দলের সংঘর্ষে প্রথম প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনা ঘটে ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর। জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান ও মহানগর বিএনপির সদস্য মাহবুবুল্লাহ তপনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনাটি ঘটে।

এরপর চলতি বছরের ৬ মার্চ সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও ইপিজেডের ঝুট ব্যবসা দখলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলি চলে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

চলতি নভেম্বর মাসে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পরপর চারটি গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এতে এক ঘটনায় বাড়ির ভেতরে থাকা এক গৃহবধূ গুলিবিদ্ধের ঘটনা ঘটে।

১৫ নভেম্বর শহরের মাসদাইরে মোবাইল ফোন নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে সাবেক কৃষকদল নেতা নাহেদুর রহমান পারভেজকে মারধর, ছুরিকাঘাত এবং প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। সিসিটিভি ফুটেজে এক ব্যক্তিকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায়।

হামলার পরদিন র‌্যাব অভিযানে গেলে জাহিদ ও তার সহযোগীদের গুলিতে জবা আক্তার (২২) নামে এক গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হন।

এছাড়া পুরো জেলা জুরেই বিভিন্ন সময় হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা রকম অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারেই ভেঙে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।

তবে পুলিশের দাবি, নারায়ণগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানে কোনো শিথিলতা নেই।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) তারেক আল মেহেদী বলেন, ‘লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চলছে। উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রগুলোর অবস্থান শনাক্তে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ কাজ করছে।’

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক রায়হান কবির বলেন, ‘আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। এটা নিয়ে আমরা পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। নির্বাচন কেন্দ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার যে বিষয়গুলো আছে তা বিবেচনায় নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

অভ্যুত্থানের পরবর্তী পনেরো মাসে প্রকাশ্যে অস্ত্র গুলি এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারামারির ঘটনায় এই পর্যন্ত অস্ত্র প্রদর্শনকারী কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমরা এগুলো খতিয়ে দেখছি। আমরা এটা নিয়ে খুব শীঘ্রই কাজ করব। এবং যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলো কি প্রক্রিয়া হয়েছে বা কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেগুলো আমরা দেখব।’

সেজু