হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল দেশের ইতিহাসে প্রথম: প্রধান বিচারপতি

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ | ছবি: এখন টিভি
0

রাজনৈতিক দল হিসেবে হাইকোর্টের রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের ঘটনাকে দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। আজ (মঙ্গলবার, ১৩ মে) সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চে জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পেতে করা আপিলের শুনানিতে তিনি এই পর্যবেক্ষণ দেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটাই ইতিহাসে প্রথম, যেখানে হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে।’

এদিন শুনানিতে জামায়াতের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক ও আইনজীবী শিশির মনির। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।

এর আগে গত ৭ মে আপিল বিভাগ জামায়াতের নিবন্ধন সংক্রান্ত আপিলের শুনানির জন্য ১৩ মে দিন ধার্য করে। যদিও ১২ মার্চ এ সংক্রান্ত আপিলের শুনানি শুরু হলেও পরে তা আর এগোয়নি।

২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে করা একটি খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দেন। এর ফলে দলটির পক্ষে নতুন করে আইনি লড়াই চালিয়ে নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পাওয়ার পথ খুলে যায়।

জানা গেছে, ১৯৮৬ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী দলীয় প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করে আসছে। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন দলটিকে সাময়িকভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দেয়। এরপর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ এবং সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন হাইকোর্টে রিট করে জামায়াতের নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করেন।

২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। আদালত বলেন, নির্বাচন কমিশন দলটিকে নিবন্ধন দিয়ে আইনি সীমা অতিক্রম করেছে। একই সঙ্গে আদালত জামায়াতকে সরাসরি আপিল করার অনুমতি দেয়। জামায়াতের আবেদন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত ৫ আগস্ট খারিজ করে দেয়। এরপর ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে জামায়াতে ইসলামী নিয়মিত আপিল করে।

২০১৩ সালের ওই রায়ের পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত অংশ নিতে পারেনি। পরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন দিয়ে দলটির নিবন্ধন বাতিল করে।

এরপর ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ইসিকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করে, দাঁড়িপাল্লা প্রতীক কাউকে বরাদ্দ না দিতে এবং বরাদ্দ দেওয়া হলে তা বাতিল করতে। কারণ, দাঁড়িপাল্লা সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একই প্রতীক রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে বলে মত দেয় আদালত। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৯ মার্চ ইসি নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করে, যাতে নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বাদ দেওয়া হয়।

২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে জামায়াতে ইসলামী বিবৃতি দেয়। দলটির তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলেন, প্রতীক বাতিলের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

বর্তমানে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে অংশ নিতে হলে ইসির নিবন্ধন আবশ্যক। ইসির কাছে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫০টি। প্রতিটি দলের জন্য একটি করে প্রতীক সংরক্ষিত রয়েছে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য রয়েছে ২৫টি প্রতীক। এখানে কোথাও দাঁড়িপাল্লা নেই।

প্রসঙ্গত, নিবন্ধন হারানো ও প্রতীক না থাকার কারণে জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি। ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর, কোনো আইনজীবী না থাকায় জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।

এরই মধ্যে ২০২৩ সালের ১ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারায় দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে পরে, ২৮ আগস্ট সরকার ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে।

এনএইচ