আলেপ উদ্দিন। মানুষের চেহারায় এক ভয়ংকর অমানুষ। জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নিরীহ মানুষকে গুম, রিমান্ডের নামে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অমানবিক নির্যাতন আর বিচারবহির্ভূত হত্যায় যিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। র্যাব-১১'র কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করা এই আলেপ ছিলেন পুলিশের এএসপি। ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে পারার দক্ষতার কারণে সে ছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন।
মূলত জঙ্গি সেলের ইনচার্জের দায়িত্ব পাওয়ার পরই আলেপ হয়ে উঠেন নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। জানা যায়, নিজেকে 'জল্লাদ' ও 'টার্গেট শ্যুটার' নামে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতো এই আলেপ।
বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী কিংবা ব্যবসায়ী, মতের অমিল হলে কেউই বাদ যেতেন না তার নির্যাতনের হাত থেকে। শুধু গুমই নয়, রেহায় পায়নি এক আসামীর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া স্ত্রীও। স্বামীকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে রোজা ভাঙিয়ে স্ত্রীকে একাধিক করা হয় ধর্ষণ। এমন অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম।
চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘তার স্বামীকে হত্যার ভয় দেখিয়ে তাকে একাধিকবার রমজান মাসে রোজা ভাঙ্গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে এমন প্রমাণাদি আমাদের হাতে এসেছে।’
জঙ্গি নাটক সাজিয়ে, স্ত্রী সন্তানকে ধরে এনে নির্যাতন ও ভয় দেখিয়ে মনগড়া জবানবন্দি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তাদের খুশি রাখতেন এই আলেপ। নির্যাতনের স্বীকার হওয়া ভয়ংকর সেসব বর্ণনার কথা এখন টেলিভিশনকে জানান বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী।
পতিত সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে আলেপের বিরুদ্ধে গুমের অর্ধশতাধিক অভিযোগ পড়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউটর তারেক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তার গুম ও জঙ্গি নাটক এসব করেছেন তিনি র্যাব ১১ তে কর্মরত থাকাকালীন।’
র্যাবের সাবেক এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নিরীহ মানুষকে ক্রসফায়ার, গুম, ধর্ষণের মতো বড় অভিযোগ থাকা স্বত্বেও খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় ও পুলিশের সর্বোচ্চ পদক পিপিএম ও বিপিএম। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের মদদপুষ্ট থাকা ও ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই শাস্তির পরিবর্তে তাকে দেয়া হয়েছিল সম্মাননা। আর তাতেই সে আরো বেপরোয়া হয়েছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ খুবই মারাত্মক ও ভয়ংকর পর্যায়ের অভিযোগ। এমন অভিযোগের পুনরাবৃত্তি যাতে ভবিষ্যতে না হয়, সেই লক্ষ্যে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার ব্যবস্থা করা ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া খুব জরুরি।’
দরিদ্র পরিবারের সন্তান আলেপ উদ্দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অবস্থাতেই জড়ান ছাত্র-লীগের রাজনীতিতে। পুলিশে যোগ দেয়ার পরই কুড়িগ্রামে তার এলাকায় শুরু হয় আধিপত্য বিস্তার। তিস্তা-কুড়িগ্রাম রেলপথের জমি দখলের অভিযোগও পাওয়া যায় তার পরিবারের বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া এলাকায় কাজ করেন র্যাবের এই কর্মকর্তা। যাত্রাবাড়ি থানায় হত্যা মামলায় ১৩ নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।