মজুরি বৈষম্যে সংকটে চা শ্রমিকরা; ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধানের প্রত্যাশা

চা বাগান থেকে চা পাতা তুলছেন একজন নারী শ্রমিক | ছবি: এখন টিভি
0

মজুরি বৈষম্যসহ নানা কারণে মানবেতর জীবন চা শ্রমিকদের। তাদের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন সময় দাবি তোলা হলেও আইনি জটিলতাসহ নানা সঙ্কটে আলোর মুখ দেখেনি। মালিকপক্ষ, শ্রমিক ইউনিয়ন ও সরকার মিলে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মধ্য দিয়ে সংকটগুলো নিরসন চান সাধারণ শ্রমিকরা। প্রশাসন বলছে, ভূমির মালিকানার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

১৭১ বছর পেরিয়ে গেলেও ভূমির অধিকার পায়নি চা শ্রমিকরা। সফল হয়নি দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রাম। নিজেদের জমি না থাকায় কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণেও হতে হয় বঞ্চিত। সমস্যা হয় ছেলে-মেয়েদের সরকারি চাকরিতে ঢুকতেও। পারেন না বসবাস উপযোগী ঘর তৈরি করতে। ঘর করতে গেলে শ্রম আইনের বিধান তুলে তাদেরকে ঘর তুলতে দেয়া হয় না।

বাগান কর্তৃপক্ষকে বারবার বলার পরও তাদের ঘর মেরামত করে দেয়া হয় না। মজুরি বৈষম্যের শিকার বলেও অভিযোগ করেন তারা।

জমির মালিকানা না থাকায় প্রতিনিয়তই হীনমন্যতায় ভোগেন চা শ্রমিকরা। এমনকি ভিটে হারানোর ভয়ে উচ্চ শিক্ষিত হলেও বাগান ছেড়ে অন্য চাকরি করতে পারছে না তাদের সন্তানরা। কারণ, চা বাগানের শ্রম আইনের ৩২ ধারায় উল্লেখ আছে- বাগান কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোনো সময় নোটিশ দিয়ে কাজ বন্ধ করে দিলে বসবাসের জায়গাসহ সবকিছু বাগান কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়ে বাগান ছেড়ে চলে যেতে হয়। এ আইনের পরিবর্তন দাবি করেন তারা।

শ্রমিকরা বলছেন, এখন যে জমিটুকু নিজেদের দখলে আছে সেখানেও বৈষম্য। কারো দখলে আছে ১০ থেকে ৩০ শতক, আবার কারো কাছে প্রায় ৫ কেদারেরও বেশি। এটার অবসান চান তারা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘আপনার চাকরি চলে গেলে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে। এ আতঙ্কের মধ্যে থেকেও আমরা চা বাগানে কাজ করে যাচ্ছি।’

চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপদেষ্টা রাম ভজন কৈরী বলেন, ‘পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানায়া আমি রই’- এভাবে একটি জীবন মনস্তাত্ত্বিকভাবে একজন শ্রমিক একজন নাগরিক অনেক পেছনে পড়ে যায়। আমার তো কোনো ঠিকানা নেই।’

আরও পড়ুন:

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন মনু-ধলাই ভ্যালীর সভাপতি ধনা বাউরী বলেন, ‘একটি পরিমাণ ধরুন ৩০ শতক বা ২০ শতক যদি প্রতিটি শ্রমিককে জায়গা দেয়া হয় তাহলে সমাধান আসবে। এর আগে সমাধান আসবে না। আর এগুলো লিজকৃত জমি বহিরাগতদের কাছে বিক্রিও করা যাবে না।’

মালিক পক্ষ বলছে, বাগানের স্থায়ী শ্রমিকদের জন্য ঘর আছে। অস্থায়ী শ্রমিকদের সরকার চাইলে ঘর করে দিতে পারে।

সিলেট অঞ্চল বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান জি এম শিবলী বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থাকে, সেই প্রকল্পের আওতায় নন-ওয়ার্কারদের সরকার ঘর করে দিতে পারে।’

শ্রমিক নেতারা বলছেন, সব দেশেই চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি তিনশো টাকার উপরে। শুধু বাংলাদেশেই ১৮৭ টাকা। চা শ্রমিকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা। প্রশাসন বলছে, ভূমির মালিকানার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

মৌলভীবাজার বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস বলেন, ‘চা শ্রমিকদের ভূমির অধিকারে সঙ্গে সঙ্গে চা শ্রমিকরা যেন ভূমি বিক্রি করতে না পারে। কারণ এটি একটি বিশেষ শিল্প। এ শিল্পের ভূমি ব্যবস্থাপনা যদি বিশেষভাবে নির্ধারিত না থাকে তাহলে শিল্পে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।’

মৌলভীবাজার কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাখন চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘যারা চা বাগানে এরইমধ্যে ঘর করে আছেন, ওই অনুসারেই অনুমোদন হয়ে আসবে। কোনো পরিবারের হয়তো পাঁচ শতক প্রয়োজন কোনো পরিবারের দশ শতক আমরা ওই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব।’

প্রায় পৌনে দুইশো বছর আগে নিজভূমি থেকে টাকা রোজগারের জন্য আসা সম্প্রদায়টি নিজেদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চান। ভূমির মালিকানাসহ চা উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি নির্ধারণ চান তারা।

এফএস