জলাধারের নগর চট্টগ্রাম: দুই দশকে বিলীন ৪০ শতাংশ পুকুর-দীঘি, বিপন্ন প্রাকৃতিক ভারসাম্য

চট্টগ্রাম শহরের পুকুর | ছবি: এখন টিভি
3

সাগর পাহাড় নদীর শহর হিসেবে পরিচিত হলেও, ইতিহাসে জলাধারের নগর চট্টগ্রাম। সম্ভ্রান্ত জমিদার, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, মোগল সম্রাট বা রেলের বিকাশে যেই নগরে একসময় প্রাণ সঞ্চার করতো প্রায় পাঁচ হাজারের মতো পুকুর-দীঘি। প্রকৃতির রূপ আর পাখির ঝাঁকে ধরা দিতো এক ভালোবাসার শহর। অথচ অপরিকল্পিত উন্নয়নের ডামাডোলে হারিয়ে গেছে সেসব জলাধারের জৌলুস। সিডিএ বলছে, দুই দশকে এ নগরের দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ পুকুর দীঘি। এতে শুধু প্রকৃতির রুক্ষতা বাড়েনি, বেড়েছে নগরের উষ্ণতা আর অগ্নিঝুঁকিও।

দীঘির বুকে শান্ত জলের মায়াবী খেলা। শীতল হাওয়া শরীরে দোলা দিয়ে জুড়িয়ে দেয় মন। ক্লান্ত পথিক, তৃষ্ণার্ত পাখির দল বা তপ্ত নাগরিক, এই জলের সাথে হৃদয় মেলায়। প্রকৃতি যখন উষ্ণ, এই শহর যখন বিষণ্ণ, কিংবা মানুষ যখন ক্লান্ত তখন এই জল-হাওয়া জোগায় বেঁচে থাকার গান।

সাগর পাহাড় নদীর শহর হিসেবে পরিচিত হলেও, ইতিহাসের পাতায় একসময় জলাধারের নগর হিসেবেও খ্যাতি ছিলো চট্টগ্রামের। সম্ভ্রান্ত জমিদার, ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ বা রেলের বিকাশে যেইখানে প্রাণ সঞ্চার করতো এমন অসংখ্য দীঘি বা জলাশয়। যেসব ঘিরে শাপলা শালুকের হাসি, পাখিদের কলকাকলি কিংবা জলের হৃৎস্পন্দনে মানুষ খুঁজে নিতো প্রকৃতির সাথে তার বন্ধুত্ব। শহরের মানচিত্রে এমন হাজারও ভালোবাসা আর প্রশান্তির এমন ৫ হাজার জলাধার খুঁজে পাওয়া গেলেও আজ সেসব যেন হারিয়ে যাওয়া রূপকথা।

নগরের হারিয়ে যাওয়া জলাধার নিয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ভিন্ন রকম তথ্য থাকলেও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এই কর্মকর্তা বলছেন, ৫০ বছরে নগর থেকে হারিয়ে গেছে অন্তত ৩৫ শতাংশ জলাধার।

সিডিএ’র উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এলাকার ভেতরে আমাদের পিএস অনুযায়ী চার হাজার ৬০০টি পুকুর ছিল। বর্তমানে আমরা পেয়েছি দুই হাজার ৯৫৪টি পুকুর। এ পুকুরগুলো আমাদের অবশ্যই সংরক্ষণের তালিকায় আছে। এগুলো যেন ভবিষ্যতে কোনোভাবে ভরাট হতে না পারে, সে নির্দেশনা আমাদের মাস্টারপ্ল্যানে থাকবে।’

আরও পড়ুন:

ছোট হয়ে আসা এ তালিকায় কোনোমতে দম ফেলছে ভেলুয়ার দীঘি, আসকার দীঘি, খাজার দীঘি, বলুয়ার দীঘির মতো মাত্র ২৮ দীঘি। ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে, এগুলোর নামকরণ হতো খননকারী, তার বংশ বা প্রিয়জনের নামে। এসবের সাথে জড়িয়ে আছে লোকগাঁথা, যুদ্ধের ইতিহাস বা কল্পকাহিনী।

একসময়ের সবুজ চট্টগ্রামের উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের রাখার পাশাপাশি একেকটি জলাধার ছিল জীবন্ত বাস্তুতন্ত্র। সেসবে দল বেঁধে নামতো পাখি, খেলা করতো নানা রকম মাছের ঝাঁক, আশেপাশের গাছগাছালি ঘিরে তৈরি হতো বিপুল অক্সিজেনের উৎস। এইসব জল আর প্রকৃতি হত্যায় নগরের একদিকে বেড়েছে জলাবদ্ধতা অন্যদিকে তাপমাত্রা।

কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের ছোটবেলায় আসকার দীঘি একদম পানিতে ভরপুর থাকতো, রাস্তা থেকে দেখা যেত। আমরা যখন স্কুল থেকে ফিরতাম তখন ওখানে পাড়ে বসতাম এবং একটা ঠান্ডা বাতাস আসতো।’

নগর পরিকল্পনাবিদ এ আর শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘এক হচ্ছে আমাদের মুনাফার প্রতি লোভ। আরেকটা হচ্ছে নগরের যে সত্যিকার চেহারা, নগরের যে সত্যিকার উপাদানগুলো— এগুলো বুঝতে না পারা। এসব কারণে এসবগুলো আমাদের অজান্তেই শহরকে নিজেরাই ধ্বংস করে দিচ্ছি।’

স্থানীয়দের মধ্যে একজন বলেন, ‘জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে। এ জলাধার সংরক্ষণ আইন আছে কিন্তু এটার সুনিপুণ বাস্তবায়ন নেই।’

নগরের নতুন মাস্টারপ্ল্যান আর কর্পোরেশনের পরিকল্পনায় জলাধার রক্ষা ও উদ্ধার গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মেয়র এসব দীঘি জলাধারকে নান্দনিক পরিকল্পনায় সাজানোর ঘোষণা দিলেও বাধ সাধছে দখল ও সহযোগিতার অভাব।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আসকার দীঘির পাড়ের ব্যাপারে এখনও কথাবার্তা চলছে ফার্নিচারের দোকানদারের সঙ্গে। তারা আমাদের সঙ্গে যদি কথাবার্তার মাধ্যমে এখনও ছেড়ে দিতে রাজি হচ্ছে না। ছেড়ে দিলে আমরা সেটা সুন্দর ওয়াকওয়ে এবং দৃষ্টিনন্দন স্থানে পরিণত করবো।’

এত দখল দূষণের মাঝে ঐতিহাসিক লালদিঘী তৈরি করেছে ব্যতিক্রমী উদাহরণ। এ দিঘী ও পাড় সংরক্ষণের কারণে চারপাশে প্রতিদিন শ্বাস নেয় কিংবা প্রশান্তিতে হেঁটে বেড়ায় নগরবাসী।

এসএস