৪৯ বছর ধরে কবর খোঁড়া মনু মিয়ার সঙ্গী ঘোড়াটি মারলো কে!

মনু মিয়া ও তার সঙ্গী ঘোড়া
মনু মিয়া ও তার সঙ্গী ঘোড়া | ছবি: সংগৃহীত
0

ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বৃদ্ধ মনু মিয়া, বয়স ৬৭। শরীরে একাধিক রোগ বাসা বেঁধেছে। চোখে দৃষ্টি ঝাপসা, কিন্তু মন এখনো টানছে দূরের সেই গ্রামের দিকে, যেখানে কেউ মারা গেলে তিনিই প্রথম ছুটে যেতেন, হাতে কোদাল নিয়ে। কিন্তু কী করে ছুটে যাবেন? তিনদিন হলো তিনি জানেনেই না যে, তার ছুটে চলার সঙ্গী, জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রাণী ঘোড়াটি আর বেঁচে নেই।

ঘোড়াটি কেবল তার বাহনই ছিল না, ছিল একান্ত আপন, যে কথা বলত না। তবু যেন সব অনুভূতি বুঝত। সেই ঘোড়াটিকে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা বল্লম দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে।

মনু মিয়া জানেন না, জানানো হয়নি। পরিবার চেপে গেছে সংবাদ। কারণ তারা জানে, এই খবর হয়ত মনু মিয়ার ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের শেষ আশাটুকুও মুছে দিতে পারে।

ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মনু মিয়া দীর্ঘ প্রায় ৪৯ বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে কবর খননের কাজ করে আসছেন। তাঁর হাতে খুঁড়ে যাওয়া তিন হাজারের বেশি কবর এখনো সাক্ষী মানবিকতার এক অনন্য অধ্যায়ের।

প্রায় এক দশক আগে নিজের শেষ সম্বল, বাজারের একটি ছোট দোকান বিক্রি করে কিনেছিলেন একটি ঘোড়া। কারণ তখন পায়ে হেঁটে আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। সেই ঘোড়াটিই হয়ে ওঠে তার সহচর। দিনের আলো হোক কিংবা রাতের অন্ধকার, মানুষের মৃত্যু সংবাদ পেলেই টগবগ টগবগ করে ছুটে যেতেন। হাতে কোদাল, কাঁধে ফাতিলা কাপড়। চোখে নির্ভীক নিষ্ঠা।

সেই প্রাণপ্রিয় সঙ্গীটিই গত শুক্রবার (১৬ মে) সকালে ঘাস খেতে গিয়ে আর ফিরেনি। তিনি যতদিন ছিলেন সন্তানের মত আগলে রাখতেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হওয়ায়। ঘোড়াটির দেখভালের কেউ ছিল না। 

গত বৃহস্পতিবার (১৫ মে) পাশের হাশিমপুর গ্রামে ঘাস খেতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ঘোড়াটি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিথর দেহে পরিনত হয় মনু মিয়ার প্রিয় এ বাহন। 

এলাকাবাসীও হতবাক হয়ে পড়ে। মনু মিয়ার মত তার ঘোড়াটিও ছিল ব্যাপক জনপ্রিয় সবার কাছে। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে কেউ কেউ কান্না আটকে রাখতে পারেনি। 

কেউ কেউ বলেন, ‘মনু চাচার ঘোড়াটির মতো এমন প্রাণী আর আসবে না। আঘাত শুধু ঘোড়াটিকে করা হয়নি বরং মনু চাচাকে আঘাত করা হয়েছে। আঘাত করা হয়েছে মানবতাকে।’

ঘোড়ার মৃত্যুর খবর শুনে এলাকার কয়েকজনকে সাথে নিয়ে শুক্রবার সকালেই ঐ স্থানে ছুটে যান রিজন আহমেদ।

তার ভাষ্যমতে, ঘোড়াটি যেখানে পড়ে ছিল, আশপাশের কিছু লোকের তোপের মুখে পড়ে আর ফেরতও আনতে পারেননি। তিনি জানান, এখনো ঘোড়ার নিথর দেহটি পড়ে আছে একটি জমিতে। 

তারই এক প্রতিবেশী আলমগীর বলেন, ‘মনু চাচা এক পয়সাও নেন না কারও কাছ থেকে। মৃত্যুর সংবাদ শুনলেই চলে যেতেন। সেই মানুষটির ঘোড়াটিকে এভাবে হত্যা করা, এটা তো পশু হত্যা নয় শুধু, পুরো সমাজের বিবেকের মৃত্যু।’ 

এলাকার সন্তান অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ রোকন রেজার প্রত্যাশা, মনু মিয়া দ্রুতই সুস্থ হয়ে ফিরবেন তার কাজে। তবে তার যে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে, তার পাশে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। সেই সাথে এমন অমানবিক কাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন বলেন, ‘মনু মিয়ার ঘোড়ারটিকে যারা হত্যা করেছে। তাদেরকে আইনের মাধ্যমে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।’ 

মিঠামন থানায় একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদের বিচার ও ঘোড়ার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তিনি। তিনি মনে করেন, তারা কেবল একটি প্রাণ নেয়নি, ইতিহাসের অংশকে হত্যা করেছে।

মিঠামইন থানার ওসি আলমগীর কবির দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেন, ‘তদন্ত চলছে। খুব দ্রুতই আমরা অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনব।’

মনু মিয়া হয়তো এখনো ভাবছেন, তাঁর ঘোড়াটি উঠোনে ঘাস খাচ্ছে। অথবা কারো জানাজায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। 

তিনি জানেন না, সেই ঘোড়াটি এখনো নিজের ‘শেষ ঠিকানা’ পায়নি। তার কবর এখনও খুঁড়ে দেওয়া হয়নি। কারণ যিনি অন্যের কবর খুঁড়তেন, তিনিই তো শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়।

যদি সুস্থ হয়ে ফিরতে পারেন মনু মিয়া, হয়তো নিজ হাতে খনন করবেন তার প্রিয় সঙ্গীর কবর। কোদালের প্রতিটি ঘায়ে হয়তো পড়বে এক ফোঁটা করে চোখের জল। মাটিতে চাপা পড়বে শুধু একটি দেহ নয়— একটি বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, আর ইতিহাস।

এসএইচ