সাধারণ ছুটি কী? (What is a General Holiday)
সাধারণ ছুটি মূলত সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এমন একটি দিন, যেদিন দেশের সকল নাগরিককে দাপ্তরিক কাজ থেকে বিরতি দেওয়া হয়। এটি সাধারণত নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১ (Negotiable Instruments Act, 1881)-এর অধীনে সরকার কর্তৃক স্বীকৃত। এই ছুটির মূল উদ্দেশ্য হলো কোনো বিশেষ জাতীয় দিবস উদযাপন, ধর্মীয় উৎসব পালন বা বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে নাগরিকদের চলাচলে সুবিধা প্রদান করা।
আরও পড়ুন:
সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার প্রক্রিয়া (Process of Public Holiday Declaration)
বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রধান দুটি ধরণ রয়েছে:
তফসিলি ছুটি (Scheduled Holiday): প্রতি বছরের শেষ দিকে পরবর্তী বছরের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি তালিকা প্রকাশ করে, যা মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত হয়। যেমন—ঈদ, পূজা, স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস।
নির্বাহী আদেশে ছুটি (Holiday by Executive Order): আকস্মিক কোনো পরিস্থিতি, কোনো বিশেষ রাষ্ট্রীয় নেতার মৃত্যু কিংবা জরুরি কোনো দুর্যোগের সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিক যে ছুটি ঘোষণা করে, তাকে নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটি বলা হয়।
সাধারণ ছুটিতে যা যা বন্ধ থাকে (What remains Closed)
সাধারণ ছুটি কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে নিচের ক্ষেত্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়:
- সকল সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অফিস (Government and Autonomous Offices)।
- সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (Educational Institutions)।
- সকল তফসিলি ব্যাংক (Scheduled Banks) ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
- উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম (Judicial Activities), তবে আদালতের বিশেষ ডেস্ক বা জরুরি বিভাগ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে খোলা থাকতে পারে।
আরও পড়ুন:
যা যা ছুটির আওতার বাইরে থাকে (Essential Services - Exceptions)
সাধারণ ছুটি ঘোষিত হলেও নাগরিক জীবন সচল রাখতে এবং জননিরাপত্তার স্বার্থে কিছু বিভাগ সবসময় খোলা রাখা বাধ্যতামূলক। এগুলো হলো:
- জরুরি জনসেবা (Public Utilities): বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহ।
- স্বাস্থ্যসেবা (Healthcare): হাসপাতাল, ক্লিনিক ও জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবা।
- নিরাপত্তা ও উদ্ধার: পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং কোস্ট গার্ড বা বন্দর সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম।
- যোগাযোগ: টেলিফোন, ইন্টারনেট ও ডাকসেবা সংশ্লিষ্ট কাজ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সাধারণ ছুটির নিয়ম
সরকারি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলে অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানা তা অনুসরণ করে। তবে জরুরি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা গার্মেন্টস সেক্টর তাদের নিজস্ব নীতি অনুযায়ী এবং কর্মীদের অতিরিক্ত ভাতা (Overtime) প্রদানের মাধ্যমে কাজ চালু রাখতে পারে।
আরও পড়ুন:
সাধারণ ছুটি বনাম ঐচ্ছিক ছুটি: মূল পার্থক্য ও নিয়মাবলী
সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশের ছুটির ক্যালেন্ডার মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হলো সাধারণ ছুটি (General Holiday) যা সবার জন্য বাধ্যতামূলক, আর অন্যটি হলো ঐচ্ছিক ছুটি (Optional Holiday) যা ব্যক্তিগত ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া যায়।
সাধারণ ছুটি (General Holiday)
সাধারণ ছুটি হলো সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এমন দিন, যা দেশের সকল নাগরিক এবং সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য।
- বাধ্যবাধকতা: এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক বন্ধের দিন।
- প্রতিষ্ঠানের অবস্থা: এই দিনে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক (Banks and Educational Institutions) সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে।
- উদাহরণ: স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, দুই ঈদ, দুর্গাপূজা, বড়দিন এবং বুদ্ধ পূর্ণিমা। এছাড়া বিশেষ পরিস্থিতিতে ঘোষিত নির্বাহী আদেশের ছুটিও সাধারণ ছুটির অন্তর্ভুক্ত।
- আইনি ভিত্তি: এটি মূলত নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট (Negotiable Instruments Act) অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়।
ঐচ্ছিক ছুটি (Optional Holiday)
ঐচ্ছিক ছুটি হলো এমন কিছু বিশেষ দিন যা নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য নির্ধারিত থাকে।
- বাধ্যবাধকতা: এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। একজন চাকরিজীবী বছরে মাত্র নির্দিষ্ট সংখ্যক (সাধারণত ৩ দিন) ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করতে পারেন।
- প্রতিষ্ঠানের অবস্থা: ঐচ্ছিক ছুটির দিনে অফিস বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে। যারা ওই নির্দিষ্ট ধর্মের বা উৎসবের অনুসারী, তারা আগে থেকে অনুমতি নিয়ে ছুটি নিতে পারেন।
- উদাহরণ: শবে বরাত, ঈদে মিলাদুন্নবী, সরস্বতী পূজা, খ্রিষ্টানদের ইস্টার সানডে কিংবা বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উৎসব।
- আবেদন প্রক্রিয়া: এই ছুটি ভোগ করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আগে থেকেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে অনুমোদন নিতে হয়।
সাধারণ ছুটি ও ঐচ্ছিক ছুটির তুলনামূলক ছক
বিষয় সাধারণ ছুটি (General Holiday) ঐচ্ছিক ছুটি (Optional Holiday) প্রয়োজনীয়তা এটি জাতীয় বা প্রধান ধর্মীয় উৎসবের জন্য। এটি ব্যক্তিগত ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য। অফিস-আদালত সকল অফিস ও ব্যাংক বন্ধ থাকে। অফিস খোলা থাকে, শুধুমাত্র আবেদনকারী ছুটিতে থাকেন। বাধ্যবাধকতা সরকার কর্তৃক ঘোষিত হওয়ার পর এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক। এটি ঐচ্ছিক; কেউ চাইলে কাজ করতে পারেন, চাইলে ছুটি নিতে পারেন। সংখ্যা বছরে সাধারণত ২০-২২ দিন হয়ে থাকে। তালিকায় অনেক দিন থাকলেও বছরে মাত্র ৩ দিন নেওয়া যায়। আবেদন কোনো আবেদনের প্রয়োজন হয় না। আগে থেকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা অনুমোদন প্রয়োজন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটির আইন: শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের অধিকার ও বিধিমালা
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের ছুটির বিষয়টি শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারায় স্পষ্ট করা হয়েছে। সরকারি সাধারণ ছুটি ঘোষিত হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজের ধরণ অনুযায়ী ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তবে আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
১. সাপ্তাহিক ছুটি (Weekly Holiday)
দোকান বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান: প্রতি সপ্তাহে অন্তত দেড় দিন (১.৫ দিন) পূর্ণ ছুটি পাবেন। (ধারা ১০৩)।
কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান: প্রতি সপ্তাহে এক দিন পূর্ণ ছুটি পাবেন। এটি সাধারণত শুক্রবার হয়, তবে আলোচনার ভিত্তিতে অন্য দিনও হতে পারে।
২. উৎসব ছুটি (Festival Holiday)
প্রতি ক্যালেন্ডার বছরে একজন কর্মী ১১ দিনের বেতনসহ উৎসব ছুটি পাবেন। (ধারা ১১৮)।
যদি কোনো কর্মীকে উৎসব ছুটির দিনে কাজ করতে হয়, তবে তাকে এর বিনিময়ে ২ দিনের বিকল্প ছুটি (Compensatory Holiday) অথবা অতিরিক্ত মজুরি প্রদান করতে হবে।
৩. নৈমিত্তিক ছুটি (Casual Leave)
জরুরি বা আকস্মিক প্রয়োজনে একজন কর্মী বছরে ১০ দিনের বেতনসহ নৈমিত্তিক ছুটি পাবেন। এই ছুটি সাধারণত পরবর্তী বছরের জন্য জমা থাকে না (Non-cumulative)। (ধারা ১১৫)।
৪. অসুস্থতা বা পীড়া ছুটি (Sick Leave)
একজন কর্মী বছরে ১৪ দিনের পূর্ণ বেতনে অসুস্থতা জনিত ছুটি পাবেন। তবে এজন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হতে পারে। (ধারা ১১৬)।
৫. অর্জিত ছুটি বা বার্ষিক ছুটি (Annual/Earned Leave)
কাজ করার মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে এই ছুটি নির্ধারিত হয় (ধারা ১১৭):
কারখানা/শিল্প: প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন ছুটি।
দোকান/বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান: প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন ছুটি।
সংবাদপত্র কর্মী: প্রতি ১১ দিন কাজের জন্য ১ দিন ছুটি।
এই ছুটি জমা রাখা যায় এবং চাকরি ছাড়ার সময় এর বিপরীতে টাকা (Encashment) পাওয়া যায়।
৬. মাতৃত্বকালীন ছুটি (Maternity Benefit)
নারী কর্মীরা মোট ১৬ সপ্তাহের (১১২ দিন) বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন। এর মধ্যে সন্তান প্রসবের আগে ৮ সপ্তাহ এবং পরে ৮ সপ্তাহ। (ধারা ৪৬)।
সাধারণ ছুটি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
সরকার যখন নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটি (General Holiday) ঘোষণা করে (যেমন: খালেদা জিয়ার জানাজার জন্য ৩১ ডিসেম্বর ঘোষিত ছুটি), তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত তা অনুসরণ করে। তবে জরুরি সরবরাহ বা প্রোডাকশন চালু রাখতে হলে মালিকপক্ষ প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে পারেন, সেক্ষেত্রে কর্মীদের অতিরিক্ত মজুরি (Overtime/Holiday Allowance) বা বিকল্প ছুটি দেওয়া বাধ্যতামূলক।



