ঘামের দুর্গন্ধ সৃষ্টির কারণ
গবেষকদের মতে, ঘামের দুর্গন্ধের জন্য প্রধানত দায়ী হলো বিও এনজাইম। এই এনজাইমটি বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার (প্রধানত স্টেফালোককাস হমিনিস) মধ্যে থাকে, যা মূলত বাহুমূলে বাসা বাঁধে এবং দুর্গন্ধ তৈরি করে।
অন্যান্য কারণ
পুষ্টিহীনতা ও ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি: শরীরে পুষ্টি বা ম্যাগনেসিয়ামের অভাব হলে ঘাম থেকে বাজে গন্ধ হতে পারে।
পোশাক ও স্বাস্থ্যবিধি: সিনথেটিক কাপড় (যেমন রেয়ন ও পলিয়েস্টার) দুর্গন্ধ বাড়াতে পারে। এছাড়া, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় ঘামের সঙ্গে বেশি বর্জ্য ও বিষাক্ত পদার্থ বের হয়, যা দুর্গন্ধের কারণ।
ব্রোমিড্রোসিস: অতিরিক্ত ঘামের কারণে ত্বকের ব্যাকটেরিয়া ঘাম ভেঙে দিলে যে তীব্র গন্ধ বের হয়, তাকে ব্রোমিড্রোসিস বলে। এটি ইক্রাইন (হাত, পা, মাথা) ও অ্যাপোক্রাইন (বাহুমূল) দুই প্রকার হতে পারে।
স্বাস্থ্যগত জটিলতা ও ওষুধ: ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, লিভারের কর্মহীনতা, কিডনি ফেইলিওর এবং হরমোনের ওঠানামার কারণে দুর্গন্ধ হয়। কিছু ওষুধ, যেমন অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগস বা আয়রন সাপ্লিমেন্ট, অতিরিক্ত ঘাম ও দুর্গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে।
খাদ্যতালিকা: ওজন কমানোর জন্য কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বাদ দিলে ঘামের দুর্গন্ধ হতে পারে। স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট ঘামের গন্ধ দূর করতে সহায়ক।
ডিওডোরেন্ট নাকি অ্যান্টিপার্সপিরেন্ট?
ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় ডিওডোরেন্ট ও অ্যান্টিপার্সপিরেন্টের ভূমিকা ভিন্ন।
অ্যান্টিপার্সপিরেন্ট মূলত ঘাম নিঃসরণ কমায়। এতে থাকা অ্যালুমিনিয়াম লবণ ঘর্মগ্রন্থির নালিগুলোতে বাধা তৈরি করে সাময়িকভাবে ঘাম উৎপাদন কমিয়ে দেয়। তীব্র গরম বা ব্যায়ামের মতো চাপযুক্ত পরিস্থিতিতে এটি ব্যবহার করা ভালো। আবার ডিওডোরেন্ট ঘাম কমায় না, বরং দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে বা নিষ্ক্রিয় করে শুধু গন্ধ দূর করে। প্রতিদিনের স্বাভাবিক ঘামের গন্ধ দূর করার জন্য এটি যথেষ্ট।
ডিওডোরেন্ট ব্যবহারের নিয়ম
ডিওডোরেন্ট সকালে ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো মূলত সুগন্ধি উপাদানের ওপর ভিত্তি করে এবং অ্যান্টিপার্সপিরেন্টের মতো কাজ করে না, তাই বিশ্রামের সময় প্রয়োজন হয় না।
এসব তথ্যই বাতলে দেবে, আপনার কোন পণ্যটি ব্যবহার করা উচিত। যদি ঘামের গন্ধ প্রতিরোধ যথেষ্ট হয়, তাহলে একটি ডিওডোরেন্ট বেছে নিন। তবে যদি সামনে চাপযুক্ত পরিস্থিতি, তীব্র গরম, বা বড় ধরনের ওয়ার্কআউট থাকে, তাহলে অ্যান্টিপার্সপিরেন্ট ব্যবহার করাই সঠিক হবে।
মুখের দুর্গন্ধের কারণ ও প্রতিকার
কারণ:
(১) দাঁতের প্লাক ও মাড়ির প্রদাহ (পেরিওডেন্টাল ডিজিজ)।
(২) মুখে ঘা, ক্ষত বা ক্যান্সার।
(৩) আঁকাবাঁকা দাঁতে খাদ্য কণা জমা।
(৪) পেপটিক আলসার, লিভার বা কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থা, ক্যানসার ইত্যাদি শারীরিক রোগ।
(৫) ধূমপান, ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল সেবনের ফলে মুখগহ্বর শুষ্ক হয়ে যাওয়া।
প্রতিকার:
(১) দিনে অন্তত দুবার দাঁত ও জিহ্বা পরিষ্কার করা (টাং ক্লিনারের সাহায্যে)।
(২) খাওয়ার পর মাউথওয়াশ ও গরম লবণ-পানিতে কুলকুচি করা।
(৩) মুখের লালা নিঃসরণ বাড়াতে প্রচুর পানি পান এবং চিনিবিহীন চুইংগাম বা লজেন্স ব্যবহার করা।
(৪) ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য বর্জন করা।
পায়ের দুর্গন্ধ দূর করার উপায়
পোশাক: পাতলা লেদার বা কাপড়ের জুতা এবং সুতির মোজা ব্যবহার করুন। ভারী জুতা ও নাইলন/পলিস্টারের মোজা এড়িয়ে চলুন।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: প্রতিদিন মোজা পরিবর্তন করুন এবং নিয়মিত জুতা রোদে শুকিয়ে নিন।
পাউডার ও লোশন: মোজা বা জুতার মধ্যে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল পাউডার (যেমন ট্যালকম পাউডার বা বোরিক অ্যাসিড) ব্যবহার করা যেতে পারে।
ন্যাচারাল সল্যুশন: আধা চামচ এপসম সল্ট মেশানো পানিতে ২০ মিনিট পা চুবিয়ে রাখলে দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি মেলে।
ঘরোয়া উপায়ে দুর্গন্ধ দূর করার প্রাকৃতিক উপায়
ঘামের দুর্গন্ধ দূর করতে কিছু প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন-
১. বেকিং সোডা
বেকিং সোডা ময়লা দূর করার জন্য অনেক আগে থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়াও আন্ডার আর্মের ঘামে যে ক্ষতিকর ব্যকটেরিয়া থাকে, তা বেকিং সোডা ব্যবহার করে প্রতিরোধ করা যায়। তাই ঘাম হলেও সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায় না। প্রথমে সাবান দিয়ে ভালোমতো বগল পরিষ্কার করে নিয়ে একটি তোয়াল দিয়ে মুছে ফেলুন । তারপর সেখানে শুষ্ক বেকিং পাউডার ব্যবহার করুন।
২. তুলসি পাতা
তুলসি পাতা দিয়ে বানানো চা প্রাকৃতিকভাবে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া থেকে রক্ষা করে। প্রতিদিন এই চা পান করলে ঘাম কম হবে এবং ঘামে দুর্গন্ধ হবে না। প্রথমে অল্প পরিমাণ তুলোর বল ঠাণ্ডা তুলসি পাতার চায়ে ভিজিয়ে নিয়ে বগলে হালকা ঘষে লাগান। এক পরতা চা লাগানোর পর না শুকানো পর্যন্ত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। এরপর আবার একই স্থানে চায়ে ভেজানো তুলো হালকাভাবে ঘষে লাগান। শেষে শুকিয়ে আসলে পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন।
৩. শালগমের রস
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে শালগমের রস ব্যবহারের মাধ্যমে ঘামের বিশ্রী গন্ধ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এটির রস ব্যবহার করলে অন্তত দশ ঘন্টার জন্য আপনার বগলের ঘাম থেকে বিশ্রী গন্ধ ছড়াবে না। শালগমের রস তুলার বলে নিয়ে আন্ডার আর্মে আলতো করে লাগান। ৫ মিঃ ম্যাসাজ-এর পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৪. চন্দন কাঠের গুঁড়ো
মোহনীয় সৌরভের জন্য চন্দন কাঠের জনপ্রিয়তা সব সময়ের মতো এখনো লক্ষ্য করা যায়। এটি দুর্গন্ধহীন আন্ডার আর্ম পেতে খুবই কার্যকরী ন্যাচারাল সল্যুশন। চন্দন কাঠ গুঁড়ো করে বগলে লাগান এবং প্রতিমূহুর্ত থাকুন সতেজ।
৫. অ্যাপল সাইডার ভিনেগার
আপেল সাইডার ভিনেগার এমন একটি ভিনেগার যা তৈরি হয় আপেলের রস দিয়ে এবং অ্যাসিডিক হওয়ার কারণে এটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে আন্ডার আর্মকে দুর্গন্ধমুক্ত রাখরে পারে। ডিওডোরেন্ট-এর বিকল্প হিসেবে আপেল সাইডার ভিনেগার ব্যবহার করে প্রাকৃতিকভাবে আন্ডার আর্মকে সুরভিত রাখুন ।
৬. লেবুর রস
অ্যাসিডিক বৈশিষ্ট্যের জন্য লেবুর রস আন্ডারামকে রাখে দুর্গন্ধহীন। এছাড়াও এই রস নিয়মিত ব্যবহার করলে আন্ডার আর্মের কালো দাগ ধীরে ধীরে কমে যায়।
৭. গোলাপ জল
গোলাপের মন মাতানো সৌরভের জন্য সৌন্দর্য সচেতন মানুষ সৌন্দর্যচর্চার অংশ হিসেবে বহুকাল থেকেই গোলাপ জল ব্যবহার করে আসছেন । তুলোর বল গোলাপ জলে ভিজিয়ে তা বগলে লাগিয়ে রাখুন। আন্ডারআর্মের ত্বককে মসৃণ ও কোমল রাখতে, বডি-স্প্রে ব্যবহারের পরিবর্তে গোলাপ জল ব্যবহার করুন।
ঘাম নিয়ন্ত্রণের উপায়
অতিরিক্ত ঘাম বা হাইপারহিডরোসিস অনিয়ন্ত্রিত স্নায়ু পদ্ধতির কারণে হতে পারে।
ভিটামিন বি-এর ব্যবহার: কলা, ডিম, দুধ, গাজর, মাছ, কাঠ বাদাম ইত্যাদি ভিটামিন বি-১২ এবং বি পরিবারের (বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৫) খাদ্য গ্রহণ করা।
খাদ্য বর্জন: আয়োডিনযুক্ত খাবার (যেমন এসপারাগাস, ব্রকোলি) এবং পান, ক্যাফেইনযুক্ত কফি, ধূমপান এড়িয়ে চলুন।
অন্যান্য উপায়: পাকা ফলমূল, শাকসবজি ও পুষ্টিকর খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া। টনিক এসিডযুক্ত চায়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাত-পা ভিজিয়ে রাখা বা সবুজ চা পান করা উপকারী। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করাও জরুরি।
এসব নিয়ম মেনে চলার পরও সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে অবশ্যই একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত।





