পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “বলে দাও, আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম” (সুরা আন’আম: ৬৫)।
এ আয়াতটি থেকে স্পষ্ট করে যে, আল্লাহ তাআলা আকাশ (যেমন—শিলাবৃষ্টি, ঝড়) অথবা জমিন (যেমন—ভূমিকম্প) উভয় দিক থেকেই মানবজাতির ওপর বিপর্যয় পাঠাতে সক্ষম। আরও ইরশাদ হয়েছে, “আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই” (সুরা বনি ইসরাইল: ৫৯)।
এই আয়াতগুলোর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, প্রকৃতির বুকে ঘটে যাওয়া যেকোনো ভয়াবহ ঘটনা, যেমন—ভূমিকম্প, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য একটি সতর্কতা ও ভীতি প্রদর্শন। এ নিদর্শনগুলোর উদ্দেশ্য হলো বান্দারা যেন পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে, আল্লাহর দিকে ফিরে আসে এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।
যেহেতু সরাসরি ভূমিকম্পের জন্য রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশেষ কোনো দোয়া বর্ণিত হয়নি, তাই বিশেষজ্ঞরা এ সময় কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত সর্বাধিক শক্তিশালী কয়েকটি দোয়া পড়ার পরামর্শ দেন। এই দোয়াগুলো সর্বাবস্থায় আল্লাহর রহমত, সাহায্য ও বিপদ থেকে মুক্তি নিশ্চিত করে।
আরও পড়ুন:
১. হযরত ইউনুস (আ.)-এর দোয়া (বিপদ থেকে মুক্তির জন্য)
এটি সেই দোয়া, যা আল্লাহর নবী ইউনুস (আ.) ঘোর বিপদে মাছের পেটে একবার ঢুকে পড়েছিলেন এবং আল্লাহ তাকে সেই মহাবিপদ থেকে মুক্ত করেছিলেন। যেকোনো গুরুতর সঙ্কটে এ দোয়াটি পড়া অত্যন্ত কার্যকর:
আরবি দোয়া: لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
বাংলা উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।
অর্থ: "তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তুমি পবিত্র সুমহান; আমি জালিমদের দলভুক্ত।" (সুরা আম্বিয়া: ৮৭)
২. বিপদ থেকে সার্বক্ষণিক সুরক্ষার দোয়া (দৈনিক আমল)
হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দোয়ার বিশেষ ফজিলত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিদিন ভোরে ও প্রতি সন্ধ্যায় এই দোয়াটি যে তিনবার পাঠ করবে, কোনো কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না। তাই এটি নিয়মিত পাঠ করলে ভূমিকম্পসহ যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে:
আরবি দোয়া: بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
বাংলা উচ্চারণ: বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইয়ুন ফিল আরদি, ওয়ালা ফিস সামায়ি ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম।
অর্থ: ‘আল্লাহ তাআলার নামে, যার নামের বরকতে আকাশ ও মাটির কোনো কিছুই কোনো অনিষ্টতা করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ (সুনানে আবু দাউদ, সুনানে তিরমিজি)
আরও পড়ুন:
৩. রাসুলুল্লাহ (সা.) এই দোয়ার মাধ্যমে জীবনের নানা অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন, যা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পড়া যেতে পারে।
আরবি দোয়া: اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَدْمِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ التَّرَدِّي وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْغَرَقِ وَالْحَرَقِ وَالْهَرَمِ وَأَعُوذُ بِكَ أَنْ يَتَخَبَّطَنِي الشَّيْطَانُ عِنْدَ الْمَوْتِ وَأَعُوذُ بِكَ أَنْ أَمُوتَ فِي سَبِيلِكَ مُدْبِرًا وَأَعُوذُ بِكَ أَنْ أَمُوتَ لَدِيغًا
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল হাদমি ওয়া-আউযুবিকা মিনাত তারাদ্দি, ওয়া-আউযুবিকা মিনাল গারাকি ওয়াল-হারাকি ওয়াল-হারাম, ওয়া-আউযুবিকা আন-ইয়াতাখব্বাতানিশ শাইতনু ইনদাল মাওতি, ওয়া-আউযুবিকা আন আমুতা ফি সাবিলিকা মুদবিরান ওয়া-আউযুবিকা আন-আমুতা লাদি-গান।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে চাপা পড়ে বা গহ্বরে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করা থেকে আশ্রয় চাই, পানিতে ডুবে ও আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করা থেকে আশ্রয় চাই। আমি আপনার কাছে শয়তানের প্ররোচনায় মৃত্যু থেকে আশ্রয় চাই এবং আপনার পথে পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারী হয়ে মৃত্যুবরণ করা থেকে আশ্রয় চাই এবং আমার যেন শেষ বয়সেও (বৃদ্ধাবস্থায়) মৃত্যু না হয়, সে বিষয়েও আশ্রয় চাই। এই দোয়াটি বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ও কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পঠিত হয়। (হাদিস: আবু দাউদ, ১৫৫২)
আরও পড়ুন:
৪. কোরআনে বর্ণিত এই আয়াতটি পাঠ করা যেতে পারে, যা ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য আগুনকে শীতল ও শান্তিতে রূপান্তরিত করেছিল:
আরবি দোয়া: يَا نَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ
উচ্চারণ: ইয়া না-রু কুউনি বারদান ওয়া-সালামান আলা ইবরাহিম।
অর্থ: ‘হে আগুন! তুমি ইব্রাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া: ৬৯)
ভূমিকম্প বা দুর্যোগ চলাকালীন কিছু জিকির
ভূকম্পন শুরু হলে বা আতঙ্ক অনুভব করলে সঙ্গে সঙ্গে একজন মুসলমানের উচিত আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা রাখা এবং জিকির করা:
ইস্তিগফার: বেশি বেশি ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ পাঠ করা। এর অর্থ হলো: ‘আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ বিপদ থেকে মুক্তির জন্য পাপ মোচন করা সবচেয়ে জরুরি আমল।
তাওহীদ: আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিয়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বা ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই’ এই জিকিরটি বেশি বেশি পাঠ করা।
আল্লাহর ওপর ভরসা: বিপদে আত্মসমর্পণের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়ে এই দোয়াটি পাঠ করা: ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি'মাল ওয়াকিল’ যার অর্থ, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, আর তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক!’
আরও পড়ুন:
দুর্যোগ পরবর্তী আমল ও করণীয়
কম্পন থেমে গেলে বা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে একজন মুসলমানের উচিত আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং নিম্নোক্ত আমলগুলো করা:
নফল সালাত: বিশেষভাবে আল্লাহর কাছে সাহায্য ও নিরাপত্তা চেয়ে নফল নামাজ (Nawafil Salat) আদায় করা।
সাদকা প্রদান: হাদিস অনুযায়ী, দান-সাদকা আল্লাহর ক্রোধকে প্রশমিত করে। তাই সাধ্যমতো গরিব, অসহায় বা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা।
সবর (ধৈর্য): আল্লাহর ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থেকে ধৈর্য ধারণ করা এবং ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তারই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী) পাঠ করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা।
ইসলামিক চিন্তাবিদরা জোর দেন—আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগী হওয়া এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমেই আল্লাহর সাহায্য ও নিরাপত্তা লাভ করা সম্ভব।
রাসুল (সা.) তার উম্মতদেরকে বিশেষভাবে উপদেশ দিয়েছেন যে, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বা বিপদের সম্মুখীন হলে আতঙ্কিত না হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করতে এবং তার কাছে সাহায্য ও আশ্রয় প্রার্থনা করতে।





