ক্রমবর্ধমান অস্থিরতায় ৮০ বছর পূর্ণ করল জাতিসংঘ

জাতিসংঘ ভবন ও লোগো
জাতিসংঘ ভবন ও লোগো | ছবি: সংগৃহীত
0

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৮০ বছর পূর্ণ করেছে জাতিসংঘ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক গড়ে তোলা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্দেশেই জাতিসংঘের সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বর্তমানে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি, যেখানে দিন দিন বাড়ছে মানবিক সঙ্কট ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা।

১৯৪৫ সালের ২৬ জুন, সারা বিশ্বের ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সংস্থা বিষয়ক সম্মেলনে মিলিত হয়ে একটি সনদ প্রণয়ন করেন। এটির খসড়া তৈরি হয়েছিল ১৯৪৪ সালের আগস্ট-অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ডামবার্টন ওকসে চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে। সনদটি কার্যকর হয় ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর। প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরেকটি বৈশ্বিক সংঘাত প্রতিরোধ এবং অকার্যকর জাতিপুঞ্জের পরিবর্তে একটি কার্যকর সংস্থা গঠনের লক্ষ্যে দেশগুলো একত্রিত হয়ে জাতিসংঘ গঠন করেছিল।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অধ্যাপক ভেরোনিকা ফিকফাক বলেন, ‘জাতিসংঘ ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর একত্রিত হওয়া বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তারা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে।’

তবে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সারাবিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গঠিত জাতিসংঘ বর্তমানে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে দিন দিন বাড়ছে মানবিক সঙ্কট ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা।

অধ্যাপক ভেরোনিকা ফিকফাক বলেন, ‘গেল দুই দশক ধরে, জাতিসংঘ নতুন সংকট, নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রগুলির একত্রিত হয়ে চুক্তির মাধ্যমে দ্বন্দ্ব সমাধানে অনীহার মতো সমস্যার মুখোমুখি আগে হতে হয় নি সংস্থাটিকে।’

তৃতীয় বছরে গড়িয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ যা জাতিসংঘ সনদের মূলনীতিকে ক্ষুণ্ণ করছে। রাশিয়ার অব্যাহত হামলায় ব্যাপক বেসামরিক প্রাণহানি ও বাস্তুচ্যুতি ঘটছে। সুদানে সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর সংঘাত বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ত্রাণ পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, ৭ অক্টোবর হামলার পর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের জেরে গাজাও ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।

আরও পড়ুন:

অধ্যাপক ভেরোনিকা ফিকফাক বলেন, ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিক্রিয়া ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। একইভাবে, গাজা ও সুদানের দুর্ভিক্ষও। এমন অনেক পরিস্থিতি রয়েছে যেখানে জাতিসংঘ, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদ, আশানুরূপ কাজ করতে পারেনি।’

এছাড়া অর্থ সংকটের কারণে জাতিসংঘ বর্তমানে খরচ কমানো ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির চাপে রয়েছে। ২০২৫ সালের ৮ অক্টোবর জাতিসংঘের সিনিয়র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তহবিল ঘাটতির কারণে আগামী মাসগুলোতে বিশ্বব্যাপী নয়টি অভিযানে শান্তিরক্ষীদের সংখ্যা এক-চতুর্থাংশ কমানো হবে।

জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় শান্তিরক্ষা তহবিলদাতা যুক্তরাষ্ট্র, মোট অর্থায়নের ২৬ শতাংশেরও বেশি তহবিল আসে দেশটি থেকে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীন, যার অবদান প্রায় ২৪ শতাংশ। জাতিসংঘকে এই অর্থপ্রদান স্বেচ্ছামূলক নয় বরং বাধ্যতামূলক।

জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের ১ জুলাই নতুন অর্থবছর শুরু হওয়ার আগেই জাতিসংঘের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বকেয়া ছিলো ১.৫ বিলিয়ন ডলার, এখন যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২.৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে নতুন করে আরও ১.৩ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে জানিয়েছে, শিগগিরই ৬৮০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে দেশটি।

অধ্যাপক ভেরোনিকা ফিকফাক বলেন, ‘বেশ কিছু দেশ তাদের জন্য ধার্য তহবিল পরিশোধ করেনি। গত পাঁচ, দশ বছরে, আমরা একটি বাজেট সংকটের কথা বলছি যেখানে বড় দেশগুলি বিভিন্ন কারণে তাদের তহবিল পরিশোধ করতে অস্বীকার করছে। এতে জাতিসংঘ, তার কাজ সম্পাদন করতে , পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে এবং আলোচনায় কৌশলগতভাবে উপস্থিত থাকতে পারছে না। এবং আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে ছোট এবং অদক্ষ করার একটি কৌশল ছিল।’

বিশেষজ্ঞরা বলছে, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান জাতিসংঘের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছে। কিছু সদস্য রাষ্ট্র সচেতনভাবেই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্বীকার করছে এবং জাতিসংঘের প্রক্রিয়াকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।

এসএস