এ শহরে বহু কথা বাষ্প হয়ে ওড়ে, ওরা বৃষ্টি হয়ে নেমে আসেনা। কোনো মরু মানব জমিনে। হাসি-খুশি আড্ডার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে অদৃশ্য একাকীত্ব। চোখে আনন্দ ঝলকালেও বুকের ভেতরে জমে থাকে পাহাড়সম চাপ।
হতাশা-বিষণ্নতাসহ নানা কারণে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
একজন জানান, বেশিরভাগই মা-বাবা বা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। বন্ধুদের কাছেও শেয়ার করা যায় না, যে তারা কি ভাববে। আরেক শিক্ষার্থী জানান, পারিবারিক, প্রেমঘটিত ও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু ব্যাপার থাকে।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, ২০২৪ সালে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৩১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক ঘটনাই গণমাধ্যমে আসেনি।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট তানসেন রোজ বলেন, ‘বাংলাদেশে ৩০০ এর বেশি সাইকিয়াট্রিস্ট। সাইকোলজিস্ট আছেন ২ হাজারের বেশি। এই যে মাত্র আড়াই হাজার মেন্টাল হেলথ স্পেশালিস্ট তাদের দিয়ে ১৮ কোটি জনগণকে কখনোই সার্ভ করা যাবে না।’
সংস্থাটির তথ্য মতে, কেবল তরুণরা নয়, দেশের প্রায় ১৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু বিশাল একটি জনগোষ্ঠী চিকিৎসাহীন থাকায় ঝুঁকি বাড়ছে আত্মহত্যার।
এ চিত্র আত্মহত্যার ঘটনাতেই থেমে থাকছে না, আরো ভয়াবহ ছাপ রাখছে সমাজে-রাষ্ট্রে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে হবিগঞ্জে পারিবারিক কলহের জেরে দুই সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যার পর বাবা আত্মহত্যা করে। রাজশাহীর পবায় ১৫ ফেব্রুয়ারি ঋণের দায়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যার করেন মিনারুল। কুমিল্লা, সাতক্ষীরাতেই সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে এমন ঘটনা।
সমাজের বিবেক সাংবাদিকদের মাঝেও হতাশা জেঁকে বসেছে। আজকের পত্রিকার প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার তার শেষ লেখায় বলেছেন, দুঃখই হোক আমার জীবনের শেষ সঙ্গী। আর পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক।
গত এক যুগে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৮–৯ জন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যের আত্মহননের খবর নথিভুক্ত হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই নিজেদের অপমৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন প্রধানত পেশাগত ও আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং পারিবারিক সংকটের কারণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘সরকার চায় ক্লায়েন্ট তৈরি করতে। যখনই আপনি ক্লায়েন্টিজম সিস্টেম তৈরি করবেন তখন সাংবাদিকদের মধ্যে ফ্রাস্টেশন আসবে। স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদের মধ্যে হতাশা আসবে। সে হতাশা পরিবারের মধ্যে পড়বে, সমাজে পড়বে। মোটাদাগে যখন সেটা চক্রাকার হবে তখন কেউ কেউ আত্মহননের দিকে চলে যায়।’
২ হাজার মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দিয়ে চলছে ১৮ কোটি মানুষের সেবা কার্যক্রম। ৯৩ শতাংশ মানুষ জানেই না যে ডিপ্রেশনে ভুগলে সাপোর্ট সেন্টার আছে। আর এখাতে সরকারি বরাদ্দের চিত্র করুণ। দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার রোগী সার্বিক স্বাস্থ্য খাতের ১৩-১৪ শতাংশ। অথচ এর বিপরীতে বাজেট মাত্র ০.৫ শতাংশ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাফিনা বিনতে এনায়েত বলেন, ‘পরিবারের সহযোগিতা প্রথমে যেমন গুরুত্বপূর্ণ একইসঙ্গে আমরা যে কমিউনিটিতে আছি সেখানেও অ্যাটাচমেন্ট দরকার। কিন্তু এ দুটি সম্ভব হবে যদি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা থাকে। সেটা কিন্তু আমাদের জীবনের একটি সুন্দর লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।’
এক নীলাম্বর অজানা আর অদৃশ্য যন্ত্রণার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকেই হারিয়ে ফেলে বাঁচার ইচ্ছেটুকু, কেউ ছুঁতে চায় কেউবা ছুঁয়ে ফেলে মেঘমালা। অথচ শেষ মুহূর্তে একটি সহানুভূতির হাত, একটু খোলামেলা আলাপ আর কাছের মানুষের পাশে থাকা-ই পারে তাদের জীবনের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে দিতে।





