আরবি ‘তাহাজ্জুদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ রাত জাগা। ইসলামি পরিভাষায়, রাত দ্বিপ্রহরের পর ঘুম থেকে জেগে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে নামাজ আদায় করা হয়, তা-ই ‘সালাতুত তাহাজ্জুদ’ বা তাহাজ্জুদ নামাজ।
তাহাজ্জুদ কখন পড়তে হয়
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক তো জানেন তুমি কখনো রাত্রির প্রায় তিনের দুই ভাগ, কখনো অর্ধেক, আবার কখনো তিনের এক ভাগ জেগে থাকো। আর তোমার সঙ্গীদের একটি দলও জেগে থাকে। আল্লাহই দিন ও রাতের সঠিক হিসেব রাখেন। তিনি জানেন যে তোমরা এর সঠিক হিসেব রাখতে পারবে না। সে জন্য আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাপরবশ। তাই কোরআনের যতটুকু পাঠ করা তোমার পক্ষে সহজ তোমরা ততটুকু পড়ো। আল্লাহ তো জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে সফরে যাবে, আর কেউ আল্লাহর পথে সংগ্রামে ব্যস্ত থাকবে; কাজেই কোরআন থেকে যতটুকু পড়া তোমাদের জন্য সহজ তোমরা ততটুকুই পড়ো করো। তোমরা নামাজ আদায় করো, জাকাত দাও আর আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ। তোমাদের আত্মার মঙ্গলের জন্য তোমরা যা-কিছু ভালো আগে পাঠাবে, পরিবর্তে তোমরা তার চেয়ে আরও ভালো ও বড় পুরস্কার পাবে আল্লাহর কাছ থেকে। আর তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো আল্লাহর কাছে। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ ( সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত: ২০)
মধ্যরাতে যখন লোকেরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন ঘুম থেকে জেগে ইবাদত-বন্দেগি করাই তাহাজ্জুদের উদ্দেশ্য। দুপুর রাত বা মধ্য রাত থেকে সুবহে সাদিকের আগপর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা। সুবহে সাদিক হয়ে গেলে এ নামাজ আর পড়া যায় না। যদি রাত দ্বিপ্রহরের পর ঘুম থেকে জেগে ওঠার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে এশার নামাজের পর এবং বিতরের আগে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে নেওয়া যায়। তবে রাতের শেষাংশে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে সওয়াব বেশি পাওয়া যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাত
তাহাজ্জুদ নামাজ চার রাকাত পর্যন্ত পড়া যায়। মহানবী (সা.) কখনো ৪, কখনো ৮, আবার কখনো ১২ রাকাত পড়তেন। কেউ যদি এ নামাজ ২ রাকাত আদায় করেন, তাহলেও তার তাহাজ্জুদ আদায় হবে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইশার পর দুই বা ততোধিক রাকাত নামাজ পড়ে নেয়, সে তাহাজ্জুদের ফজিলত লাভ করবে।’ তাহাজ্জুদ কীভাবে পড়বেন তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়তের জন্য মধ্য রাতের পর নামাজে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ পড়ার ইচ্ছা হৃদয়ে পোষণ করাই যথেষ্ট, মুখে উচ্চারণ করতে হবে না। কিন্তু যদি মুখে আরবিতে উচ্চারণ করতে চান, তাহলে পড়তে পারেন: নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া রাকআতাইত তাহাজ্জুদি আল্লাহু আকবার। (অর্থ: দুই রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করছি, ‘আল্লাহু আকবার’।)
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অন্যান্য নামাজের মতো। তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত করা। সানা পড়া, সুরা ফাতিহা পড়া, অন্য সুরা মেলানো, রুকু, সেজদা আদায় করা। এভাবেই দ্বিতীয় রাকাত আদায় করে তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফেরানো। তাহাজ্জুদ আদায়কালে পবিত্র কোরআনের আয়াত বেশি বেশি তিলাওয়াত করা উত্তম। যদি দীর্ঘ সুরা মুখস্থ থাকে, তাহলে তাহাজ্জুদ নামাজে দীর্ঘ সুরা তিলাওয়াত করা উচিত।
১২ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজের প্রথম রাকাতে সুরা ইখলাস ১২ বার, দ্বিতীয় রাকাতে ১১ বার, তৃতীয় রাকাতে ১০ বার, চতুর্থ রাকাতে ৯ বার—এভাবে দ্বাদশ রাকাতে একবার পড়া যায়। আবার প্রত্যেক রাকাতে সুরা ইখলাস ৩ বার অথবা ১ বার হিসেবেও পড়া যায়। আবার সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াতুল কুরসি এবং সুরা আল-ইনশিরাহও পড়া যায়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর রহমত নাজিল করেন, যিনি রাতে নিদ্রা থেকে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন এবং তার স্ত্রীকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দেন। অতঃপর তিনি (তার স্ত্রী) তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। এমনকি যদি তিনি (স্ত্রী) ঘুম থেকে জেগে উঠতে না চান, তাহলে তার মুখে পানির ছিটা দিন।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১,৩০৮)
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সব নফল ইবাদতের চেয়ে বেশি। তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়। রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহ বান্দাদের প্রতি তাদের কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানান। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে নেমে এসে তার বান্দাদের ডাকেন, ‘কে আছ যে আমার কাছে প্রার্থনা করবে, যাতে আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দিতে পারি? কে আছ যে আমার কাছে কিছু চাইবে, যাতে আমি তাকে তার চাওয়া পূরণ করতে পারি? কে আছ যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, যাতে আমি তাকে ক্ষমা করতে পারি?’ (বুখারি, হাদিস: ৬,৩২১ ) তাহাজ্জুদের নামাজ বান্দাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখে।
শত্রুর ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও তাহাজ্জুদের গুরুত্ব রয়েছে। তাহাজ্জুদ নামাজে রাসুল (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণ তো হয়ই, এতে আত্মারও উন্নয়ন হয়। অবশ্য সারা রাত জেগে নামাজ পড়ার পর ভোররাতে বিশ্রাম করতে গিয়ে ফজরের নামাজ ছুটে যাওয়া উচিত নয়। কারণ, ফজরের জামাতের গুরুত্ব অনেক বেশি।
জেনে নিন তাহাজ্জুদের নামাজ সম্পর্কিত আরও প্রশ্নাবলী
প্রশ্ন: তাহাজ্জুদের নামাজে কি কি সূরা পড়তে হয়?
উত্তর: তাহাজ্জুদ নামাজে সূরা ফাতেহার পর যেকোনো সূরা বা আয়াত পড়তে পারেন, তবে এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সূরা পড়ার বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি যেকোনো ছোট বা বড় সূরা, যেমন সূরা ইখলাস, সূরা ফাতেহা, বা আয়াতুল কুরসি পড়তে পারেন। মূল বিষয় হলো, কোরআনের আয়াত বেশি বেশি তিলাওয়াত করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করা।
প্রশ্ন: কতদিন তাহাজ্জুদ পড়লে দোয়া কবুল হয়?
উত্তর:তাহাজ্জুদ নামাজ কতদিন পড়লে দোয়া কবুল হবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, তবে নিয়মিতভাবে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, বিশেষ করে রাতের শেষ তৃতীয়াংশে এই প্রার্থনা করা বেশি ফলপ্রসূ।
প্রশ্ন: রাত ১ টায় কি তাহাজ্জুদ পড়া যাবে?
উত্তর:রাত ১টায় তাহাজ্জুদ পড়া যাবে, কারণ তাহাজ্জুদ নামাজের সময় এশার নামাজের পর থেকে শুরু হয়ে ফজর উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত থাকে। ফজর আজানের আগে যেকোনো সময় এই নামাজ আদায় করা যায়, তবে রাতের শেষ তৃতীয়াংশ (শেষ রাত) তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য সবচেয়ে উত্তম সময়।
প্রশ্ন: তাহাজ্জুদ নামাজ কি ৪ রাকাত পড়া যায়?
উত্তর:তাহাজ্জুদ নামাজ চার রাকাত বা তার বেশি পড়া যায়, কারণ এটি একটি নফল নামাজ এবং এর কোনো নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা নেই। আপনি সর্বনিম্ন দুই রাকাত পড়তে পারেন এবং রাসুল (সা.)-এর আমল অনুযায়ী চার, আট, দশ বা বারো রাকাত পর্যন্ত পড়া প্রমাণিত।
প্রশ্ন: নবী সাঃ কিভাবে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন?
উত্তর:নবী (সাঃ) তাঁর ছোট্ট এক কক্ষের ঘরে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন, যা বিলাসিতা এবং পার্থিব প্রভাব থেকে মুক্ত । কখনও কখনও তাঁর কাছে নামাজ পড়ার জন্য একটি মাদুর থাকে যা তাঁকে সিজদা করার জন্য যথেষ্ট বড়। অন্য সময়ে, তাঁর কাছে কেবল তার স্ত্রীর সাথে ভাগ করা বিছানা থাকে। তিনি নামাজ আদায় করেন যখন স্ত্রী তার সামনে ঘুমিয়ে থাকে।
প্রশ্ন: বিতরের নামাজের পর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায় কি?
উত্তর:বিতর নামাজ পড়ার পরেও তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যাবে এবং এতে কোনো বাধা নেই। যদিও সাধারণত রাতের সব নামাজের শেষে বিতর পড়া হয়, তবে কেউ যদি এশার পর বিতর পড়েও ফেলেন, তাহলে রাতে ঘুম ভাঙলে তাহাজ্জুদ আদায় করতে পারেন।
প্রশ্ন: তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি নিয়ত কী?
উত্তর: আরবি: اللهم اهدنا فيمن هديت অর্থ: "হে আল্লাহ, আমাদেরকে তাদের সাথে হেদায়েত দাও যাদেরকে তুমি হেদায়েত দিয়েছ।





