সেই সময় একই পরিবারে জন্ম নিয়েও ছেলে সন্তানের তুলনায় নারীদের শিক্ষা অর্জনে সংকুচিত সুযোগ দেখে যে আক্ষেপে পুড়ছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, আর তাতেই হয়ে উঠেছিলেন ইস্পাত কঠিন দৃঢ়। এভাবেই তার চিন্তার ক্ষুরধার একদিকে যেমন অবরোধবাসিনীদের হৃদয়ে রোপণ করে দিয়েছে স্বাধীনতার বীজ তেমনি নারীদের দিয়েছে চিন্তার মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াবার অপার স্বপ্ন।
রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দের নিভৃত গ্রামে জন্ম নেয়া বেগম রোকেয়া ইতিহাসে যতটা অনন্য তার স্মৃতি রক্ষায় যেন ঠিক ততটাই উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে রাষ্ট্র। পৈত্রিক ভিটাতে তো বটেই তার নামে প্রতিষ্ঠিত রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও রোকেয়ার স্মৃতি যেন ডুমুরের ফুল।
শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার যে অবদান আমাদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে বিশেষ করে নারীদের জন্য এইটাতে মনে হয় না যে আমরা উঠে এসেছি। আমাদের পাঠ্যক্রমে তার অবদান আরো বেশি করে আনা উচিত ছিল।’
আরেকজন বলেন, ‘এখানে যেমন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল দেখতে পেয়েছি কিন্তু আমাদের চোখে এখনো বেগম রোকেয়ার ম্যুরাল দেখতে পাইনি।’
২০০৮ সালে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে কার্যক্রম শুরু করলেও পরের বছর বাঙালি নারী জাগরণের প্রাণভোমরা বেগম রোকেয়ার নামানুসারে এটির নামকরণ হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১৬ বছরেও এ ক্যাম্পাসে নেই বেগম রোকেয়ার কোনো ম্যুরাল, নেই রোকেয়া বিষয়ক জ্ঞান চর্চার কোনো দৃশ্যমান আয়োজন।
বেগম রোকেয়ার মত ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশকে কেবল নামেই সীমাবদ্ধ রাখার যে হেঁয়ালি তাকে একপ্রকার অবমূল্যায়নও বলছেন সচেতন মহল।
এছাড়া বেগম রোকেয়ার বিরুদ্ধে মুসলিম বিদ্বেষের যে অভিযোগ কিংবা অনুযোগ, এর ভিত্তি কতখানি? সে জবাবও মেলে, ইতিহাসের জানালায় কান পাতলে।
বেরোবির ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহাগ আলী বলেন, ‘অনেক জায়গায় তিনি ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। আমরা এমন কোনো তথ্য পায়না যেখানে তিনি ইসলামের বিপক্ষে কাজ করেছেন তিনি শুধু নারীদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। যেখানে নারী স্বাধীন হয়ে উঠবে।’
বৈশ্বিক বাস্তবতা শুধু প্রাচ্যে নয়, পশ্চিমা দেশগুলোতেও চর্চিত হয়েছে বেগম রোকেয়ার চিন্তা ও কর্মের মূল্যায়ন। তার রচিত সুলতানার স্বপ্ন অবলম্বনে স্প্যানিশ ভাষায় তৈরি করা হয়েছে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র।
গেলো বছর স্পেনের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিতও হয়েছে ইসাবেল হারগুয়েরার নির্মিত এ ছবিটি। এছাড়া বিবিসি বাংলার ২০০৪ সালের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচনের তালিকায় বেগম রোকেয়ার নাম রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। সেখানে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এত অবমূল্যায়ন?
শিক্ষক ও গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘বেগম রোকেয়াকে নিয়ে চর্চা করবার জন্য অনেকদিন আগেই সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাঠক্রমে অর্ন্তভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদি এটাও করা হয় তাহলে এইখানার শিক্ষার্থীরা বেগম রোকেয়াকে নিয়ে জানতে পারবে।’
এমন বাস্তবতায় নিজ ভূমেই যেন পরবাসী হয়ে আরও একটি জন্ম ও মৃত্যু দিবস কাটছে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের। জাতির জন্য যার এত অবদান, ইতিহাসের খরচা খাতায় সে ঋণ কী কভু শোধ হবে আর! সে প্রশ্ন থেকেই যায়।