হেমন্তের হাওয়ায় কিছুটা হিমেল প্রকৃতি। শিশিরের স্পর্শ গাছের পাতায় পাতায়। পায়ের তলায় সবুজ ঘাসেরা সিক্ত। কিন্তু নগরজীবনে দেখা নেই শীতের কুয়াশার। পাতারা আচ্ছন্ন ধূসর ধুলোয়। সবুজ গাছেরা যেন প্রাণহীন। বাতাসে বিষবাষ্প। নিঃশ্বাসে মিশছে বিষাক্ত বায়ু। বিশ্বে বায়ুদূষণের তালিকায় প্রথম সারির শহর ঢাকা। বাতাসের মান সূচকে অস্বাস্থ্যকর। নগরের যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, ইস্টার্ন হাউজিংসহ বিভিন্ন এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টের ৯টি নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয় না। দূষণ রোধে দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড নেই বলে অভিযোগ নগরবাসীর। অনিয়মিতভাবে পানি ছিটানো, রাস্তা সংস্কারে অবহেলা পরিবেশকে করে তুলছে অস্বাস্থ্যকর। এ বিপর্যয় থেকে যেন রেহাই নেই কারোরই।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র-ক্যাপসের গবেষণা বলছে, রাজধানীতে সারাবছর যে বায়ুদূষণ হয় তার ৬০-৬৫ শতাংশই হয় নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্যাপসের বায়ুমান পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এ সময়ে ঢাকায় বায়ুদূষণ বেড়েছে প্রায় ১০-১২ শতাংশ।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীত মৌসুমে বৃষ্টিপাতের অভাব, ইটভাটা চালু, অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঢাকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ছে। বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫ এর মাত্রা বার্ষিক ৩৫ মাইক্রোগ্রাম থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে দশগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
পরিবেশবিজ্ঞানী আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘গত নয় বছরে তিন হাজার দিন পর্যবেক্ষণে আমরা দেখেছি ঢাকার মানুষ মাত্র ৫০ দিন নির্মল বায়ু পায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেউই এটি নিয়ে চিন্তিত নয়।’
উচ্চমাত্রায় বায়ুদূষণে শুধু পরিবেশ নয়, হুমকিতে স্বাস্থ্যও। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, নিউমোনিয়াজনিত রোগীর সংখ্যা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে বয়স্ক ও শিশু রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সুরক্ষা পেতে বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহারসহ নানা পরামর্শ চিকিৎসকদের।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, ‘শীতকালে মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা বেশি হয়, যাদের হাঁপানি রয়েছে তা আরো বেড়েছে যায়। যেকোনো রোগ হবার আগে রোগ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতে হবে। আর তাই সুস্থ থাকতে হলে আমাদের বায়ুদূষণ রোধ করতে হবে।’
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালে দূষিত বায়ুর নগরীর তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। চলতি বছরেও বেশ কয়েকবার বাতাসের মান সূচকে ৩শ'র বেশি স্কোর নিয়ে চরম অস্বাস্থ্যকর নগরীর তালিকায় জায়গা করে নেয় ঢাকা।
ঢাকার বায়ুমান হ্রাসের জন্য স্থানীয় দূষণের পাশাপাশি আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণকে দায়ী করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, ৩০-৩৫ শতাংশ বায়ু দূষণের কারণ এটি। নির্মল বায়ু নিশ্চিত করতে আইনের প্রয়োগসহ সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দেন কর্মকর্তারা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ‘সমন্বিতভাবে এ বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেয়া দরকার। এছাড়া যে আইন ও নীতিমালাসহ হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো যদি সঠিকভাবে প্রতিপালন করা যায় তাহলে দূষণ অনেকটা কমে আসবে।’