নিয়ম ভাঙার মহোৎসবই সড়কের সাধারণ চিত্র। উলটো পথে যাত্রা, যত্রতত্র পারাপার, মূল সড়কে গাড়ি পার্কিং, আর বেপরোয়া পাবলিক বাসের স্বেচ্ছাচারিতা- এছাড়াও রয়েছে পথচারী-যাত্রীদের অসচেতনতাসহ বহু প্রতিবন্ধকতা। অনিয়মের ফিরিস্তি শোনালেন চালকরা।
রিকশা চালকদের একজন বলেন, ‘আমাদের জ্ঞানে যতটুকু আছে কোনো রোডে গেলে সমস্যা হবে আমরা ওইভাবেই সড়কে যায়।’
মোটরসাইকেল চালকদের একজন বলেন, ‘কোথাও পুলিশ নেই। তারা ট্রাফিকের কাজ তেমন ভাবে করছে না যার ফলে সড়কে জ্যাম লেগেই থাকছে।’
নিমজ্জিত সড়ক এড়িয়ে চলতে পথচারী আর যানবাহন ছুটছে যে যার মতো। ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারা তোয়াক্কা করছেন না কেউই। এক ট্রাফিক পুলিশের বক্তব্য জানতে চাইলেও উপরমহলের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে নারাজ তিনি। তাই মাঠের চিত্র জানতে কৌশলী হতে হয় আমাদের।
ট্রাফিক পুলিশের একজন বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ ট্রাফিক আইন না মানলে দুর্ঘটনা ঘটে। যে মানবে না তার উল্টোপথে চলে হাত-পা ভাঙবে।’
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বেহালের কারণ হিসেবে সাধারণ মানুষের উদাসীনতাকে দুষলেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। সঙ্গে আছে পুলিশ বাহিনীর দক্ষতাও। তবে বাহিনীতে ব্যাপক রদবদলে পুলিশের কাঠামো পরিবর্তন হওয়ার ফলাফলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে আশাবাদী তিনি।
ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, ‘শুধু আইন প্রয়োগ করে ২০ শতাংশ লোককে মানানো যাবো। ৮০ ভাগ লোক যদি তা না মানে সেখানে তাদের অর্ডারে আনা কঠিন।’
পুলিশের সংস্কারেই রাজপথ সরল হবে এমন ধারণা অলীক বলে মতামত দিলেন সাবেক আইজিপি। বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাঠে দায়িত্বরতদের বোঝা-পড়ায় দূরত্ব কমলে উন্নতি হতে পারে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, ‘দ্রুত আসবে না তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। রাস্তায় শৃঙ্খলা না আনতে পারলে অন্য জায়গাও আনা যাবে না।’
সিগন্যাল বাতি কার্যকর করা, লেন মানাসহ ট্রাফিকিং সঠিক পথে আনতে আগেও নানার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে কোনটিই টেকেনি। ঢাকা শহরজুড়ে সিগন্যাল বাতি রয়েছে কেবল গুলশান ২ সার্কেলে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এবার আসছে নব উদ্যোগ।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ হাতে ইশারায় যেটা করে সেটা যদি ট্রাফিক বাতির মাধ্যমে করা যায় সেখানে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।’
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, ‘৫ আগস্টের আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা অনেকটা সম্ভব হয়েছে। এখন কিন্তু রাস্তায় হকার ফ্রি স্টাইলে আর বসে না।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এক সাইনবোর্ডে কক্সবাজারের ইনানী যাওয়ার রাস্তার সন্ধান মিললো এখনের ক্যামেরায়। এই দিকনির্দেশনার পথ ধরে দেখে আসি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামের সড়কের হালচাল।
নগরের ব্যস্ততম মনসুরাবাদ এলাকার সড়কের তিন কিলোমিটার ধরে হঠাৎ দীর্ঘ যানজট। তাই বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে মধ্য দুপুরের সূর্যোত্তাপ মাথায় নিয়ে নানা বয়সী মানুষের এমন ভোগান্তি যাত্রা।
যাত্রীদের একজন বলেন, ‘ডাক্তার দেখানোর জন্য রওনা দিয়েছি কিন্তু পৌঁছাতে পারছি না আগ্রাবাদে। জ্যাম অনেক হয়ে আছে।’
রাজধানীর মতো বন্দর নগরীতেও বেড়েছে যানজটের তীব্রতা, যাতায়াতের দুর্ভোগ। আমাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ছন্দ হারানো ট্রাফিক ব্যবস্থা ও সড়কে খানাখন্দ বাড়ায় নগরের গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতাধিক মোড় বা পয়েন্টকে ঘিরে তীব্র হয়েছে এই যানজট।
যাত্রীদের একজন বলেন, ‘মাঝপথ থেকে নেমে গিয়েছে এত জ্যাম। অফিসের লেট হয়ে গেছে তাই নেমে গিয়েছে হেঁটে যাবো অফিসে।’
যানজটে পুড়ছে তেল, হারাচ্ছে সময়, পণ্ড হচ্ছে শ্রম। পরিবহন খাতের মানুষগুলোর বেঁচে থাকার সংগ্রামকে এই যানজট যেমন কঠিন করে তুলছে তেমনি তা প্রভাব ফেলছে বন্দর কেন্দ্রিক পণ্য পরিবহন বা আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যেও।
বিজিএমইএ সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আজকের যে গাড়ি পাঠানো হচ্ছে সেটা দিনেই পৌঁছাচ্ছে না। পরের দিন গিয়ে পৌঁছাই। যার ফলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পরবে।’
দিনের দুর্ভোগ শেষ না হতেই ক্লান্ত নগরে সন্ধ্যের পর আবারও যানজট পায় নতুন মাত্রা। এই যানজট মূলত হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার কেন্দ্রিক।
নিয়ম ভাঙছেন প্রভাবশালী, সরকারি কর্মকর্তা বা ভুয়া স্টিকার লাগানো যান। ট্রাফিকিং নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও আছে শিথিলতার অভিযোগ।
চট্টগ্রাম ট্রাফিক উত্তর জোনের সহকারী কমিশনার শরীফুল আলম চৌধুরী সুজন বলেন, ‘যখন কাউকে মামলা দিতে যাচ্ছি তখন সে রিয়্যাক্ট করে বসছে।’
পুলিশের অনুপস্থিতি বা ট্রাফিক ব্যবস্থায় শিথিলতার সুযোগে গত দুই মাস ধরে নগরের মূল সড়কজুড়ে দৌরাত্ম্য বেড়েছিল ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা বা গ্রাম সিএনজির। পুলিশের ধারণা সংখ্যায় তা ৫ থেকে ৭ হাজার।
নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের ডাম্পিং সাইট এখন জব্দ করা যানের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ। এসবের অধিকাংশই গ্রাম সিএনজি অটোরিক্সা বা ব্যাটারিচালিত রিকশা। নগরের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে গত ১ মাসে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে এমন ৮ শতাধিক যান। তাই ছন্দ হারানো ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে এসব অবৈধ যানের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নামে ট্রাফিক পুলিশ।
স্বল্পমেয়াদে ট্রাফিক ব্যবস্থা বা সড়ক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন কাজ দিলেও দীর্ঘমেয়াদে টেকসই পরিকল্পনা নেয়ার দাবি বিশেষজ্ঞদের।
চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, ‘ট্রাম লাইন চালু করতে হবে। ট্রামে কস্ট কম যেখানে কম খরচে বেশি লোক নিতে পারবো। রাস্তাগুলো স্টাডি করে এর লাইন চালু করা যায় কিনা সে বিষয়ে দেখতে হবে।’
নতুন বাংলাদেশে চট্টগ্রাম নগরের সড়কগুলোকে আরও জনবান্ধব ও নির্বিঘ্ন করতে নানা টেকসই পরিকল্পনা নেয়ার মত এই বিশেষজ্ঞের।