নাগরিক সাংবাদিকতা
0

রাজশাহীর ফজলি আমের সাত সতেরো

আম খেতে ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। যে ব্যক্তি একবার এই ফল খেয়েছে তার পক্ষে ভোলা একদমই সম্ভব নয়। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে আমের চাষ হয়। তবে দেশের সব অঞ্চলে সব প্রজাতির আম পাওয়া যায় না। আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে জেলা হিসেবে রাজশাহী এগিয়ে। আর এই জেলার বিখ্যাত আমের মধ্যে অন্যতম জাত হলো ফজলি।

রাজশাহীর ৯টি উপজেলার প্রায় সব জায়গাতেই ফজলি আমের চাষ হয়ে থাকে, তবে বাঘা ও চারঘাট উপজেলায় এ জাতের আম বেশি পরিমাণে চাষাবাদ হয়।

জানা গেছে, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে রাজশাহীর বাঘা এলাকার ফজলি আম কলকাতার বাজারে ‘বাঘা ফজলি’ নামে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিল।

ফজলি আম। ছবি: সংগৃহীত

২০১৭ সালের ৯ মার্চ রাজশাহীর ফল গবেষেণা কেন্দ্র বাঘা উপজেলার ফজলি আমকে 'রাজশাহী ফজলি' জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ফজলি আম রাজশাহীর ফজলি নামে জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পায়।

যেভাবে হলো ফজলি নামকরণ

রাজশাহীর ফজলি আম আগে ফকিরভোগ নামে পরিচিত ছিল। আমটির উৎপত্তি ভারতের মালদহ জেলায়। কথিত রয়েছে, ১৮০০ সালে মালদহের কালেক্টর র‌্যাভেন সাহেব ঘোড়ার গাড়ি চেপে গৌড় যাচ্ছিলেন। পথে তার জল তেষ্টা মেটানোর জন্য গ্রামের এক নারীর কাছে জল খেতে চান।

ঘোড়ার গাড়ি চেপে গৌড় যাচ্ছিলেন কালেক্টর। ছবি: সংগৃহীত

ফজলু বিবি নামে সেই নারীর বাড়ির আঙিনায় বড় একটি আমগাছ ছিল। ফজলু বিবি সেই আম দিয়ে ফকির-সন্ন্যাসীদের আপ্যায়ন করাতেন। ফজলু বিবি কালেক্টর র‌্যাভেনকে জলের বদলে একটি আম খেতে দেন। আম খেয়ে কালেক্টর সাহেব ইংরেজিতে তাকে আমের নাম জিজ্ঞেস করেন। বুঝতে না পেরে ওই মহিলা তার নিজের নাম বলে বসেন। সেই থেকে ওই আমের নামকরণ করা হয় ফজলি।

আম চেনার উপায়

বাংলাদেশের উৎকৃষ্ট জাতের আমের মধ্যে ফজলি আম নাবি মৌসুমি ও খুবই জনপ্রিয় বাণিজ্যিক একটি জাত। এটি আকারে বেশ বড়, অনেকটা লম্বা ও চেপ্টাকৃতির হয়ে থাকে। আমটি গড়ে লম্বায় ১৩.৮ সেন্টিমিটার, চওড়ায় ৯.৫ সেন্টিমিটার, উচ্চতায় ৭.৮ সেন্টিমিটার এবং গড় ওজন ৬৫৫ গ্রাম হয়ে থাকে।

ফজলি আম। ছবি: সংগৃহীত

পাকা ফলের ত্বকের রং প্রায় সবুজ থেকে হালকা হলুদ হয়। শাঁস হলুদ, আঁশবিহীন, রসালো, সুগন্ধযুক্ত, সুস্বাদু ও মিষ্টি। এর গড় মিষ্টতা ১৭.৫ শতাংশ। পাকা ফলের খোসা পাতলা, আঁটি লম্বা, চ্যাপ্টা ও পাতলা হয়। আঁটি গড়ে লম্বা ১২.২ সেন্টিমিটার, পাশে ৫.১ সেন্টিমিটার, পুরুত্ব ১.৪ সেন্টিমিটার এবং গড় ওজন ৭৭ গ্রাম হয়ে থাকে।

সংগ্রহের সময়

আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বা জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এই আম পাকে ও আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়। ফজলি আম পাড়ার পর পাকতে ৭-৮ দিন সময় লাগে।

এ জাতের ফলন মধ্যম। ফুল আসা থেকে শুরু করে ফল পরিপক্ব হতে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস সময় লাগে। এ জাতের আমের পুরুষ ও উভলিঙ্গ ফুলের আনুপাতিক হার যথাক্রমে শতকরা ৮৬ ও ১৪ ভাগ।

গাছ চেনার উপায়

ফজলি আমের গাছ ছড়ানো ও বৃহদাকার আকৃতির হয়। গাছের উচ্চতা প্রায় ১৫-১৮ মিটার হয় এবং নিয়মিত ফল দেয়। এ গাছের পাতা বড় ও বল্লম আকৃতির হয়।

ফজলি আম গাছের পাতা। ছবি: সংগৃহীত

পাতার বোঁটা লম্বায় ৪-৭ সেন্টিমিটার, পত্রফলক লম্বায় ২৯ সেন্টিমিটার ও চওড়ায় ৮.১ সেন্টিমিটার, কচি পাতার রং লালচে এবং পাতার প্রান্ত সুচালো। পুষ্পমঞ্জুরি দেখতে টার্নিনাল আকৃতির বা পিরামিডাল হয়। সাধারণত পুষ্পমঞ্জুরির দৈর্ঘ্য ৩২ সেন্টিমিটার ও প্রস্থ ১৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফুল পুরুষ ও উভয় লিঙ্গ প্রকৃতির হয়ে থাকে।

যেভাবে বাগান তৈরি ও চারা রোপণ করতে হয়

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও ভারতের মাঝখানে অবস্থিত। বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। বৃষ্টিপাতের মাত্রা ১৫০০-২০০০ মিলিমিটার এবং গড় তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাংলাদেশের আবহাওয়া মোটামুটি আমবাগান তৈরি ও আম উৎপাদনের জন্য উপোযোগী।

ফজলি আমবাগান তৈরির জন্য প্রথমে ভালোভাবে জমি চাষ করে নিতে হয়। পরে নকশা অনুযায়ী বর্গাকার পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট জায়গায় আমের চারা রোপণ করা হয়।

বর্ষার শুরুতে অর্থাৎ জুন মাসে ফজলি আমের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। অতিরিক্ত বর্ষার সময় আমের চারা রোপণ না করাই ভাল। রোপণের আগে ১*১*১ মিটার বিশিষ্ট গর্ত করে অর্ধেক মাটি পাশে সরিয়ে রাখতে হবে।

ফজলি আমের চারা। ছবি: সংগৃহীত

গর্ত করার পর ১০-১৫ দিন গর্ত রোদে শুকাতে হবে। গর্ত ভর্তি করার সময় ওপরের মাটির সাথে ২০-৩০ কেজি গোবর সার, ৪৫০-৫৫০ গ্রাম টিএসপি, ২০০-৩০০ গ্রাম এমওপি, ২০০-২৩০ গ্রাম জিপসাম ও ৪০-৬০ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট ভালোভাবে মিশিয়ে মিশ্রিত সার মাটির নিচে ও নিচের মাটি ওপরে দিয়ে গর্ত ভর্তি করতে হবে।

গর্ত ভরাটের ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে আমের চারাটি সোজাভাবে লাগিয়ে চারদিকে মাটি দিয়ে চাপ দিয়ে দিতে হবে। রোপণের পরে গাছে সেচ দিতে হবে ও গাছটি একটি শক্ত খুঁটি দিয়ে বেঁধে দিতে হয়।

চারা লাগানোর পর পরিচর্যা পদ্ধতি

গাছের চারার বয়স ২-৩ বছর পর্যন্ত চারার গোড়া থেকে নতুন ডালপালা গজালে তা কেটে ফেলতে হবে। পাশাপাশি গাছের দেহের আকৃতিতে কোনো বিকৃতি দেখা দিলে কেটে ফেলতে হবে।

গাছের কচি পাতা শুঁড় পোকা কেটে ফেললে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ১ মিলি লিটার হারে স্প্রে দ্বারা গাছের পাতায় প্রয়োগ করে আক্রমণ প্রতিহত করতে হয়। গাছের বয়স ৪-৫ বছর হলে ফল ধরার উপযোগী হয়। সে সময় ফলন্ত গাছের পরগাছা, শুকনা ও রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে।

গাছের কচি পাতা শুঁড়পোকার আক্রমণ। ছবি: সংগৃহীত

প্রয়োজন অনুযায়ী অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করা হয়। গাছের বয়সভেদে নির্ধারিত পরিমাণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট, বরিক অ্যাসিড, অর্ধেক ইউরিয়া এবং অর্ধেক এমওপি সার সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ সময়ে প্রয়োগ করতে হয়। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার দুই ভাগে ভাগ করে এক ভাগ মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফল মটর দানার মত হলে ব্যবহার করতে হবে এবং অবশিষ্ট অংশ ফল সংগ্রহের ১ মাস পূর্বে প্রয়োগ করতে হয়।

সার প্রয়োগের পরে প্রয়োজন মতো হালকা সেচ প্রদান করতে হয়। আম গাছে পুষ্পমঞ্জুরি বের হয়েছে তবে ফুল ফোটেনি ও আম মটর দানার মত হলে এই দুই অবস্থায় সেচ প্রদান করতে হবে। খরা মৌসুমে প্রয়োজনে দুবারের অধিক সেচের প্রয়োজন হতে পারে।

রোগ দমনের উপায়

আম গাছের প্রধান প্রধান পোকামাকড়ের মধ্যে হপার, রেড ব্যানডেড ক্যাটারপিলার এবং ফ্রুট ফ্লাই অন্যতম। এগুলোকে উপযুক্ত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে হয়।

আমের রোগের মধ্যে এনথ্রাকনোজ ও বোটা পঁচা রোগ অন্যতম। এগুলোকে অনুমোদিত মাত্রার ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে এবং গরম পানির মাধ্যমে এসব দমন করা যায়। তবে আমের ফলন মাটির উর্বরতা এবং গাছের বয়সের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে।

এনথ্রাকনোজ ও বোটা পঁচা রোগ। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ফজলি আম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ফজলি আমকে ভিত্তি করেই এক সময় রাজশাহীর বাঘা আম শিল্প এবং মানুষের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল।

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও অন্যান্য জেলাতে রাজশাহীর ফজলি আম বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয়ে থাকে। ফজলি আমের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফল গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, বিনোদপুর, রাজশাহী ফজলি আমকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যে দীর্ঘ দিন যাবত এ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিকল্পনা করে আসছে।


লেখক: জান্নাতুল ফেরদৌস নাবিলা

শিক্ষার্থী, আইন অনুষদ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

ইএ