নগরীর পথে চোখ মেলে তাকালেই দেখা যায় সবুজ আর সবুজ। ছাতিম, মেহেগনী, আকাশমনি, কিংবা কড়ই পাশাপাশি সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, জারুল। বড়-বড় বৃক্ষে আচ্ছাদিত শহরের অনেক খানেই ডানা ছড়িয়ে আগলে যাচ্ছে অগ্নিবর্ষণ।
পথে প্রান্তরে তারই ছায়াতলে ক্লান্ত শরীর জুড়িয়ে নেয় প্রাণ। দিনের পর রাত এলেও এখানেই ঠাঁই নিতে হৈচৈই বাঁধে শত প্রাণের। প্রখরতার আশ্রয়ে এ সতেজ সবুজ, নগরের কতোটা জুড়ে!
তবুও মাথার ওপর গনগনে সূর্য্যের বলয় রশ্মি তীব্রতায় নগরজুড়ে ওষ্ঠাগত প্রাণ, নাকাল শ্রমিক, দিনমজুর। পরিবেশবিদেরা বলছেন, রেকর্ড তাপমাত্রার সাথে অনুভূত গরমের প্রভাব বেশি এই নগরে। তাতে গরম কমাতে খুব বেশি প্রভাব রাখে না ৯৬ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটারের এই নগরীর ৪৭.৩৯ কিলোমিটার রাস্তার পার্শ্ব পরিবেশ আর সড়কদ্বীপে লাগানো গাছ।
বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার গাছ রোপনের পাশাপাশি এর পরিচর্যায় নগর কর্তৃপক্ষের ব্যয় হয় দেড় কোটি টাকা। বিগত ৬ বছরে ৯ কোটি টাকা পরিচর্যা ব্যয়ে নগরে ২ লাখ ৪০ হাজার গাছ রোপন করেও শান্ত হয়নি রাজশাহীর প্রতিবেশ। তবে একই প্রতিষ্ঠানের সাংঘষিক কর্মসূচিই এর কারণ বলছেন পরিবেশবিদরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ সভাপতি ড. শীতাংশু কুমার পাল বলেন, 'এটা কোনোভাবেই পরিকল্পিত নগরায়ন না। এটা অপিকল্পিত নগরায়ন। এবং এই পরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আমরা গাছপালা কেটে আমরা পরিবেশকে ধ্বংস করছি। রাস্তা প্রশস্ত হচ্ছে আর পাশাপাশি যে পরিমাণ গাছ আগে ছিল সে গাছ এখন নাই।'
এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞর মতে গরমের এই প্রভাব বৈশ্বিক। তবে পদ্মা নদীর শুষ্ক বালুচর, নগরের পুকুর জলাশয় ভরাট, অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন আর অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে দিন দিন এই অঞ্চলে স্থায়ী হচ্ছে তীব্র ও অতি তীব্র তাপদাহের সময়কাল। যার ধারাবাহিকতায় গেল ৩০ এপ্রিল ৫২ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙ্গে ৪৩ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে রাজশাহীর তাপমাত্রা।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম বলেন, 'পার্শ্ববর্তী দেশের দিল্লিতে প্রতি বছরের গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশের তুলনায় তাপমাত্রা সেখানে কয়েক ডিগ্রি বেশি থাকে। দিল্লি এই তাপের প্রবাহে রাজশাহী, খুলনার তাপমাত্রা দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে গতানুগতিক বেশি হয়ে থাকে।'
২০০৮ থেকে ভূমির ব্যবহার বৃদ্ধি পায় রাজশাহী নগরীতে। প্রশস্ত হয় সরু গলিপথ। অন্যান্য সড়ক হয়েছে ফোরলেন। নগরে বাড়ছে বহুতল ভবনও। তাতে ২০২২ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন, ইকলি সাউথ এশিয়া, রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্টের যৌথ গবেষণায়, নগরীর ১৯, ২৪, ২৫ ও ২৮সহ নয়টি ওয়ার্ডকে সবচেয়ে উষ্ণ দেখানো হয়।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণা বলছে, গেল দু'দশকে রাজশাহীতে সবুজের আচ্ছাদন কমেছে ২৪ শতাংশ আর ১১ শতাংশ জলায়শ কমে নেমেছে ৪ শতাংশে। এছাড়া ১৬ শতাংশের নগর বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এতে নগরের ভূ-ত্বকের তাপমাত্রার গড় বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ফলে বাড়ছে গরমের অনুভূত।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মুহাইমিনুল ইসলাম বলেন, 'গ্রিনের এয়ার ইস্যু ১৯৯৯ সালে ছিল ৪৯ শতাংশ সেটা এখন ২৫ শতাংশের মতো আছে। বিল্ডাপ এরিয়া বাড়ার সাথে সাথে গ্রিন এরিয়া কমে যাচ্ছে। সেজন্য আমরা এখন তাপমাত্রা অনেক বেশি অনুভব করছি।'
এ অবস্থা উত্তরণে সিটি করপোরেশনের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকর্তা বলছেন, নগর সবুজায়নে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছেন তরা। তবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দ্বায়িত্বশীল ভূমিকার পাশাপাশি সবুজায়নে জনসম্পৃক্ততার কথা বলছেন তিনি।
রাজশাহী সিটি কপোরেশনের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ-উল-ইসলাম বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য থাকে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার গাছ যেন রোপন করতে পারি। আমার মনে হয় রোড এবং হাইওয়ে, বন বিভাগ যদি এগিয়ে আসে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় যদি পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ রোপন করে তাহলে শহরটা আরও সুন্দর সবুজ হবে।'
নগরীর সড়ক উন্নয়নে তালাইমারি-কাটাখালি সড়কে শতাধিক গাছ এবং কামারুজ্জামান চত্ত্বর থেকে বিমানবন্দর রোডে সড়ক প্রশস্তকরণে একই পরিমান গাছ কাটা হয়। সিটি কপোরেশন বলছে ১২ দশমিক আট এক কিলোমিটার এ সড়কে দ্রুতই গাছ লাগাবেন তারা।