হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে প্রতিদিনই মামলা সংক্রান্ত কাজে থাকে মানুষের আনাগোনা। তবে আদালত প্রাঙ্গণে বিশ্রাম নেয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাইরে গাছের ছায়ায় ঠাঁই নিতে বাধ্য হন বিচারপ্রার্থীরা। গাছের নিচেই অনেকে সেরে ফেলেন দরকারি আলাপও। এ রকমই কয়েকজন বন্ধু এসেছেন জামালপুর থেকে। চাকরি সংক্রান্ত একটি মামলায় জিতেছেন তারা। রায়ের পর তীব্র গরম থেকে রেহাই পেতে গাছের নিচে বসেছেন আড্ডায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন, গাছ হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু কিন্তু গাছ কাটার কোনো বিচার হয় না।
জামালপুর থেকে আসা বন্ধুরা গছের নিচে বসেনে আড্ডায়। ছবি: এখন টিভি
জামালপুর থেকে আসা একজন বলেন, 'কতসুন্দর নিরব, নিস্তব্ধ, ঠাণ্ডা একটা পরিবেশ গাছের নিচে। চারিদিকে রোদের যে উত্তাপ, থাকাই যায় না। কিন্তু এখানে গাছ থাকায় নিরবে, শান্তিতে বসে গল্প করতে পারছি। গাছ মানুষের কোনো ক্ষতি করে না, বরং উপকার করে বন্ধু হিসেবে। কিন্তু অনেকেই না বুঝেই গাছ কেটে ফেলে। গাছ কাটার জন্য কোনো শাস্তি নেই, কোনো বিচারও হয় না।'
এরকমই আরও অনেকেই গাছের ছায়ায় বসেছেন গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণকে শীতল ছায়ায় জুড়িয়ে নিতে। উন্মুক্ত স্থানে সূর্যের হলকা থেকে বাঁচতে গাছের চেয়ে উপকারি বন্ধু আর নেই। অথচ এই গাছই অবাধে কাটা হয় বাছবিচার ছাড়া।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২০১৯ সালে একটি প্রকল্পের জন্য গাছ কাটা শুরু হলে বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে সরে আসে প্রকল্প বাস্তবায়নকারীরা। তবে সে সময় হাইকোর্টে রিট করলে শুধু গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কাউকেই শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এরকম পাহাড়, বনাঞ্চলে গাছ কাটার বিষয়ে হাইকোর্টে কয়েকটি রিট মামলা আছে।
২০২৩ সালে মন্ত্রিপরিষদ নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় ২০৩০ সাল পর্যন্ত কেউ অনুমতি ছাড়া কোনো গাছ কাটতে পারবে না। তবে এই সিদ্ধান্ত মানছে না কেউ। দেশে এখন পর্যন্ত গাছ কাটা বন্ধ ও গাছ সংরক্ষণ করার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা নেই। ২০১২ সালে একটি আইন করার তৎপরতা শুরু হলে ২০১৬ সালে সংসদে তা থেমে যায়।
হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ ও পরিবেশ আইনজীবীদের সংগঠন বেলার কয়েকটি রিট মামলা ছাড়া গাছ কাটা নিয়ে হাইকোর্টে কোনো মামলাও নেই। আইনজীবীরা বলছেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাব ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না থাকায় এ বিষয়ে কোন আইন হচ্ছে না। আবার মামলা করা হলেও শাস্তি হচ্ছে না।
সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ এখন টিভিকে বলছেন গাছ কাটার অপরাধ সম্পর্কে। ছবি: এখন টিভি
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, 'পরিবেশ সংক্রান্ত আইনে গাছ কাটার ওপর একটা নিষেধাজ্ঞা দিলেও গাছ কাটার আলাদা কোনো শাস্তি নেই। একটা গাছ কাটলে ক্রিমিনাল অফেন্সে যে একটা শাস্তি পাবে এমনটা এখনও করা হয়নি।'
বেলা'র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'আদালত একটা হাতিয়ার হতে পারে, আইনী প্রক্রিয়া একটা মাধ্যম হতে পারে। কিন্তু সরকারকে তো জবাবদীহিতার মধ্যে নিজেকে আনতে হবে। আজকে যে অবস্থায় আমরা এসেছি, সে অবস্থা থেকে সরকারকে একটা স্পষ্ট বার্তা নিতে হবে। এই বার্তা থেকে সরকারকে জনগণের ভোগান্তি কমাতে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
অবাক করার মতো বিষয় হলো ঢাকার পরিবেশ আদালতে ২৩ বছরে গাছ কাটা নিয়ে কোনো মামলা হয়নি। সবই পলিথিন আর ইট ভাটার মামলা।
২৫ শতাংশ বন থাকার কথা থাকলেও দেশে সাকুল্যে বনাঞ্চল আছে মাত্র ৮ শতাংশ। আর রাজধানীর ঢাকায় মানুষের বসবাস অনুয়ায়ী গাছপালার আরও খারাপ অবস্থা। গাছ কাটা বন্ধে একটি কমিশন গঠন করার ওপর জোর দিয়েছেন উদ্ভিদ গবেষক অধ্যাপক মিহির লাল সাহা। তিনি মনে করেন, সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বলেন, 'বাংলাদেশে নির্বিচারে একটা পর্যায়ে গাছ কাটা হয়েছে। আমরা রাস্তার পাশে কিছুদূর পরপর বটগাছ দেখেছি। বটের যে ক্যানোপি এখন তা দেখা যাচ্ছে না। বিশাল আকারের ক্যানোপি একটা ছায়া দিতো, ক্লান্ত পথিক সেখানে বসতে পারতো। খুব ঝুকিপূর্ণ না হলে গাছ কাটা উচিত না। গাছ কাটাও একটা অপরাধ, তাদেরও বিচার হওয়া উচিত।'
বাংলাদেশে এখনও চলছে অবাধে গাছ কাটা কিংবা বন উজার করা। নির্দিষ্ট আইন না থাকার কারণে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা চাইলেও আদালতে মামলা করতে পারছেন না। আর দু'একটি মামলা হলেও আদালত দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে পারছেন না। সে কারণে এর সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তিও হচ্ছে না। তবে সরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করলে সরকার দায়ীদের আইনের আওতায় আনা অনেক সহজ হতো বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।