বাংলা বানান প্রচলনে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা আনতে পারেনি বাংলা একাডেমি। যে কারণে বানানের নৈরাজ্য থেকে মুক্তি মিলছে না।
ভাষা গবেষকদের দাবি, বানানরীতি পরিবর্তনের ব্যাকারণিক ব্যাখ্যা থাকার পাশাপাশি তার সঠিক প্রয়োগের দিকে নজর দিতে হবে।
বাঙালির জাতীয় জীবনে প্রভাব সঞ্চারী অনুষঙ্গ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। শোকের আবহ আর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় নিয়ে ফিরে ফিরে আসে ফেব্রুয়ারি। ভাষার এই মাস বাঙালির এক অনির্বাণ বাতিঘর।
ভাষা মৌখিক স্তর থেকে যখন লেখ্য স্তরে প্রবেশ করে তখন প্রয়োজন হয় বানানরীতির। একের পর এক বর্ণ বিন্যাসের খেলায় গড়ে ওঠে শব্দের গাঁথুনি। বাংলা বানানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন সর্বজনগ্রাহ্য কোনো নিয়ম চালু ছিল না।
তবে বাংলা বানান দীর্ঘ সময় আদিরূপের অনুশাসন মেনে চলেছে। একসময় বাংলা বানানে ছিল না কোন নিয়ম। এ কারণে অ-তৎসম শব্দের বানানে দেখা দিতে থাকে বিশৃঙ্খলা, অসঙ্গতি।
এই অসঙ্গতি দূর করতে বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানানের নিয়ম নির্ধারণ করে। এরপর বাংলা একাডেমির সূচলালগ্ন থেকেই অভিধান রচনায় ব্রতী হন বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বাংলা বানানকে সুশৃঙ্খল ছকে বাঁধতে ১৯৯২ সালে নতুন রীতি তৈরি হয়। শুদ্ধরীতি বজায় রাখতে ১৯৯৪ সালে প্রণিত হয় বানান অভিধান। তবে বানান প্রচলনে সর্বস্তরে যে গ্রহণযোগ্যতা আনার প্রচেষ্টা ছিল তা এখনও পূর্ণাঙ্গ পূর্ণতা পায়নি।
তবে বছর বছর বিশেষজ্ঞ কমিটি করে বানানের নিয়ম বেঁধে দেয় বাংলা একাডেমি। বেঁধে দেয়া সংশোধনীতে বলা হয়- তৎসম শব্দে রেফ-এর পরে ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। তদ্ভব, দেশি, বিদেশি শব্দে কেবল ই এবং উ 'কার' ব্যবহৃত হবে।
এদিকে দ্বিমত রয়ে গেছে ণত্ব বিধান নিয়ে। অ-তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষর নিয়ে কাটেনি সংশয়। কোথাও দন্ত্য-ন এর ব্যবহার আবার কোথাও মূর্ধণ্য-ণ এর বহুল ব্যবহার দেখা যায়।
বানান সংস্কারে বারবার সিদ্ধান্ত বদলেছে বাংলা একাডেমি। যা নিয়ে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় তাদের। চিরাচরিত ঈদ বানানে দীর্ঘ-ই কারের পরিবর্তে নিয়ম আসে হ্রস্ব-ই কারের। একইভাবে গরু বানানে ও-কার রীতি চালু নিয়ে শুরু হয় নানা সমালোচনা।
এমনকি অভিধানে থাকা অনেক বানানের ক্ষেত্রে তালব্য শ হবে আবার স দিয়েও বানান রাখা হয়েছে- যা নিয়ে প্রকাশনা, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
ভাষা গবেষকরা বলছেন, অভিধান থাকা সত্ত্বেও স্থানভেদে একই বানান লেখা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। বানানরীতি চিরস্থায়ী না হলেও এর ব্যাকারণিক ব্যাখ্যা থাকার পাশাপাশি এর সঠিক প্রয়োগে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্দেশনা থাকা জরুরি।
লেখক ও গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘আমরা একক কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারছি না। আর এ কারণে সুষ্ঠু একক বানানরীতি তৈরি করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
শিক্ষকদের ভাষা প্রতি প্রশিক্ষণ থাকা উচিত বলেও মনে করেন এই লেখক।
বানানরীতির সিদ্ধান্তে অটল থাকতে না পারাকে বাংলা ভাষার জন্য নেতিবাচক বলছেন গবেষকরা। এই নিয়ম সর্বজনগৃহীত করতে সরকারের সদিচ্ছা মূখ্য বলছেন তারা।
শিক্ষক ও গবেষক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে যে বানান সংস্কার কমিটি করা হয়েছিল ওই কমিটির প্রস্তাবকে তখন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাতিল করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন সেটি পুনঃবিবেচনা করা দরকার।’
শুদ্ধ বানান নিয়ে দ্বিধা বা সংশয় না কাটায় তা শিক্ষা কিংবা পেশাগত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভ্রাট সৃষ্টি করছে। যার প্রভাবে সাইনবোর্ড, ব্যানার ও বিলবোর্ডে চলে বানান বিকৃতি।
এই দৈন্যদশা দূর করতে সঠিক বাংলা বানানরীতি অনুসরণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ গবেষকদের।



