বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহকের প্রায় ৮৭ শতাংশই পল্লী অঞ্চলের। আর এই মাধ্যমে লেনদেন ছাড়িয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। পরিশোধ করা যায় সব ধরনের বিল। তোলা যায় রেমিট্যান্সের টাকাও। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব সেবার বাইরেও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে পাওয়া যাচ্ছে প্রচলিত ব্যাংকের সব সেবা। তাই দিনে দিনে শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলেই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিং।
সরাসরি ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে নিজস্ব এজেন্টের মাধ্যমে সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে শুরু হয় এজেন্ট ব্যাংকিং। ২০১৪ সালে যাত্রা শুরুর পর দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই সেবা, যার প্রধান সুবিধাভোগী দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ। বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহকের ৮৬.১৪ শতাংশ গ্রামের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মোট হিসাব ছিল ২ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫৩৭টি। আর এর মাঝে প্রায় অর্ধেক হিসাবই নারীদের। এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাবে এখন আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩০ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ।
বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক এজেন্ট সেবা দিয়ে থাকে, যা পৌঁছে গেছে ইউনিয়ন, পাড়া ও মহল্লা পর্যায়ে। সে হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানতের ৭৯ শতাংশই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। গত তিন মাসেই, গ্রামে আমানত বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ, শহরে এই বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪ শতাংশ। এর মধ্যে আবার সিংহভাগই নারীদের আমানত।
এজেন্ট ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যারা কাজ করে বা আমানত রাখেন তারা সকলেই ওই এলাকার। যারা ব্যাংকে আসতে ভয় পায় তারাও এখানে আসতে উৎসাহিত হয়।’
গ্রাহকদের আঙুলের ছাপ নিয়ে একাউন্ট তৈরি করা ও সহজে টাকা উত্তলনের সুযোগ দিচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং। আর বাড়ির কাছে এমন সেবা মেলায় দিন দিন আরও আগ্রহ বাড়ছে গ্রামীণ পর্যায়ে।
গ্রাহকরা বলেন, ‘আমরা সময়ের অভাবে জেলা বা উপজেলায় যেতে পারি না তাই এজেন্ট ব্যাংকিং এই সেবা নিয়ে থাকি। ব্যাংক যেসব সেবা দিয়ে থাকেন এর সবই এখান থেকে পেয়ে যাই। ব্যাংকে ৪টার পরে আর সেবা পাওয়া না গেলেও এখানে রাত ৮টা পর্যন্ত সেবা পাই।’
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ব্যাপক প্রসার হলেও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে তা ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করছেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।
বর্তমানে বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ২১ হাজার ছাড়িয়েছে। তবে তা কতটা গ্রাহকদের জন্য সুরক্ষিত করতে পারছে ব্যাংকগুলো? ব্যাংকের পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে প্রতারণার ফাঁদ পাতছে কিছু এজেন্ট। আর এতে পা দিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন অনেক গ্রাহক।
এমন প্রতারণার একটি ঘটেছে ইসলামি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জের নিমাইকাশারি বাজারের এজন্টে ব্যাংকে। তার নিষ্পত্তির এখনো কোন কুল কিনারা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিনে দেখায় যায়, সেই এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটটি বন্ধ পড়ে আছে প্রায় ৬ মাস ধরে। এই এজেন্ট ব্যাংকের যিনি স্বসত্ত্বাধিকারী প্রায় ২ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। প্রায় ৩০ জন গ্রাহকের ২ কোটি টাকা এখনো পায়নি। এর দায় কে নিবে?
প্রতারিত গ্রাহকরা বলেন, ‘এর দায় অবশ্যই ইসলামি ব্যাংকের নেয়া উচিৎ। কারণ ইসলামি ব্যাংকের নাম দেখেই আমরা এখানে টাকা জমা রেখেছিলাম। আমরা ইসলামি ব্যাংকেও গিয়েছি, তারা বিষয়টি গোপন রাখতে চায়। আমরা মামলাও করেছি কিন্তু তারা এর কোন দায় নিচ্ছেন না।’
এই এজেন্ট ব্যাংকটি পরিচালিত হতো ইসলামী ব্যাংক কাঁচপুর শাখার আওতায়। এখন টিভির পক্ষ থেকে সেখানে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও কথা বলতে রাজি হয়নি ব্যাংকটির ম্যানেজার। তবে এই প্রতারণার ঘটনায় ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে।
প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের অর্থ তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ব্যাংকের। আর্থিক খাতে প্রতারণা ঠেকাতে যাচাই-বাছাই করে এজেন্ট নিয়োগ ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘এই এজেন্ট ব্যাংকে তাদের যারা নিয়োগ দিয়েছেন এর দায় তাদেরই। কোন ব্যাংকের যদি সক্ষমতা থাকে ১০০টি এজেন্ট ব্যাংক চালানোর তাহলে তারা সেটা ভালো করে চালাক, কিন্তু তারাতো নিচ্ছে ২০০টি এজেন্ট ব্যাংক। এবং সেটা চালাতে গিয়ে পরে ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছে।’
ব্র্যাক বাংকের অল্টারনেট ব্যাংকিং চ্যানেলসের প্রধান নাজমুর রহিম বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল মাধ্যম অর্থাৎ এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে তাদের সচেতন করে থাকি। এবং তারা প্রতি মাসে দুই থেকে তিনবার এই কাজটা করেন। ফলে ওই গ্রাহকরা এজেন্ট ব্যাংকে গিয়ে তারা সরাসরি তদারকির কাজটা করে থাকেন।’
এজেন্ট ব্যাকিং সেবা দেয়া বেশ কিছু ব্যাংক জানিয়েছে, গ্রাহকদের সুরক্ষায় অত্যাধুনিক সফটওয়ারের ব্যবহারসহ নিয়মিত নজরদারি বাড়িয়েছে তারা।