ঢাকা শহরে ভাসে মানুষ। ভাসে হকার। ভেসে বেড়ান ভাসমান বণিকেরা। সঙ্গে স্বল্প পুঁজির পণ্য সম্ভার। বলা যায় ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র।
চারিদিকে শুধু ব্যস্ততাকে সঙ্গী করে ছুটে চলা মানুষ। রোজগারের পেছনে ছুটতে থাকা মানুষই এই ভাসমান বণিকদের ক্রেতা। পান-জর্দা, বাদাম-চানাচুর, মৌসুমী ফল, পানীয় জল, চা এই পসরার মুঠো পুঁজি নিয়ে পথ বাণিজ্যের এক ব্যবসায়ী ইউসুফ মিয়া এবং তার মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী ইউসুফ বলেন, 'চাকরি আমার কাছে ভাল লাগে না। কোনদিন বেশি বা কোনদিন কম হয় সে হিসাব করলে গড়ে দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বিক্রি করি।'
এক চা বিক্রেতা বলেন, '৬০০ টাকা খরচ হয়, ১ হাজার ২০০ টাকা বিক্রি হলে ৫০০ টাকার উপরে লাভ থাকে।'
জীবিকার তাগিদে ৮ বছর ধরে ফেরি করে মুখরোচক ঝালমুড়ি বিক্রি করেন ফরিদপুরের সিদ্দিক হোসেন। মাত্র ৫ হাজার টাকার পুঁজিতে শুরু করা এ ব্যবসায় প্রতিদিন বিক্রি ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। দিনশেষে লাভ করেন ৪০০ থেক ৫০০ টাকা।
সিদ্দিক হোসেন বলেন, 'আগে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা হলে পুঁজি হয়ে যেত, কিন্তু এখন সেখানে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মত লাগে। পাঁচজন ছেলে মেয়েসহ সংসার চালাই। অসুস্থ হলে আর ব্যবসা করতে পারি না। তখন কিস্তি উঠিয়ে চলতে হয়।'
অপ্রাতিষ্ঠানিক হলেও এসব ক্ষুদ্র ব্যবসা দূর করছে বেকারত্ব। আত্মনির্ভরশীল করছে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে। পুঁজির সংকটে স্থায়ী কোথাও দোকান করার ইচ্ছে থাকলেও তার সুযোগ নেই অনেকেরই। তাই বছরের পর বছর এভাবেই চলছে ব্যবসা।
বাদাম, পেয়ারা, পাপড়, প্লাস্টিক পণ্য বিক্রেতারা জানান, সমিতির ক্ষুদ্র ঋণ, নিজের স্বল্প পুঁজির সংগ্রহেই চলছে এই ব্যবসা। এভাবে বছর কেটে গেলেও, শহরের মটরের চাকার মতোই যেন শ্লথ হয়ে পড়ছে তাদের রোজগার । ইচ্ছে থাকলেও বিস্তৃত হয় না ব্যবসা।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশে মোট শ্রমশক্তির মধ্যে সিংহভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সাথে জড়িত। কর্মসংস্থান তৈরিতে মুখ্য অবদান থাকলেও সামগ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রমে আওতায় নেই তারা। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা আর সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে অনেকেই হতে পারেন না সুসংগঠিত।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যেকোন দেশের জিডিপিতে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসার ভূমিকা অপরিসীম। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭.২ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা রয়েছে। তবে বাংলাদেশে এর পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি। প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ। তবে তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেখভালের কোন ব্যবস্থা নেই।
তাই এ ধরণের ক্ষুদ্র, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা যেন ঝরে পড়া শিশুর মতো ব্যবসায়ী না হয়- সেটি নিশ্চিত করতে সুদবিহীন ঋণ দিয়ে সক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে মত তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী বলেন, 'অপ্রাতিষ্ঠানিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক করতে সরকারের কোন পরিকল্পনা আছে কি না, কারণ আপনাকে হিসেবের মধ্যে নিয়ে আসাই মূল কাজ। ট্যাক্স তা হলে দেবে না হলে দেবে না। হিসেব রাখার পদ্ধতিকে জোরদার করা উচিত। অর্থনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট রাখার জন্য যে সার্ভে করা হয় সেখানে কিভাবে এ ব্যবসাগুলো হিসেবের মধ্যে নিয়ে আসা যায় তার একটা সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।'
বিচ্ছিন্নভাবে নিয়োজিত থাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের রাখা অবদান গাণিতিক কিংবা পরিসংখ্যানগত সমষ্টিতে আসে না। আবার তাদের জন্য কোন আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেয়াও সম্ভব হয় না রাষ্ট্রীয়ভাবে। এক্ষেত্রে নিজস্ব প্রচেষ্টায় সমবায়কে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান পরামর্শকদের।