নয়নাভিরাম সবুজ শ্যামলিমায় শস্যের সমারোহের মধ্যে মেঠোপথে ছুটে চলা মানে সমৃদ্ধি আর অদম্যে এগিয়ে যাওয়া আগামীর স্বনির্ভর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। উর্বর জমিতে কৃষকের বুনা স্বপ্ন দেশের খাদ্য নিরাপত্তাসহ কৃষি অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে।
কয়েক দশক আগেও দরিদ্রতা যাদের নিত্যসঙ্গী ছিল। কৃষিতে ভর করে তাদের জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। ধান-পাট, সবজিসহ মসলা জাতীয় ফসল আবাদে তাদের সুদিন ফিরেছে।
জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি হলুদ আবাদ হয়। হলুদের গ্রাম নামে পরিচিত রাঙ্গামাটিয়ার বিস্তীর্ণ জমিতে হলুদ উত্তোলন করেন নারী শ্রমিকরা। এখানকার পাহাড়ি লাল মাটির হলুদ, রঙে, ঘ্রাণে ও স্বাদের সুনাম দেশজুড়ে।
এই গ্রামের হলুদ শ্রমিক ৫ সন্তানের জননী রেনুয়ারা বেগম। সারাদিন হলুদ তুলে আড়াইশ' টাকা পান। আর একই সময় কাজ করে একজন পুরুষ শ্রমিক পান ৬০০ টাকা। শ্রমের হাটে তার মতো হাজারও নারী শ্রমিক এই মজুরি বৈষম্যের শিকার।
শ্রমিকরা বলেন, 'আমরা সারাদিন কাজ কইরা আড়াইশ' টেহা (টাকা) পাই আর বেডাইনে (পুরুষ) পায় ৬০০ টেহা। তারার মান আমরা পাই না। তারার চাইতে কাম (কাজ) কম করি না, বেশি করি। আমরা তারার অর্ধেক মজুরিও পাই না।'
জমি থেকে হলুদ তুলছেন নারী শ্রমিকরা
এ অঞ্চলে মালা ও পাটনাই জাতের হলুদের আবাদ বেশি হয়। তবে এবার দেশিয় জাতের পাশাপাশি বিনা-১ জাতের হলুদ আবাদ করায় কৃষকরা কাঠাপ্রতি ১২ থেকে ১৫ মণ হলুদ পাচ্ছেন। যার প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায়। আর প্রতিমণ শুকনা হলুদ ৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে বিগত বছরগুলোতে মিয়ানমার ও ভারত থেকে হলুদ আমদানি হওয়ায় কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েন। এবারও সে শঙ্কা কাটেনি।
চাষিরা বলেন, 'আগের তুলনায় এইবার আবাদ একটু কম। কারণ উৎপাদন খরচটা বেড়ে গেছে। দেশের বাইরে থাইকা হলুদগুলা যদি না আসে তাইলে আমরা হলুদের দাম ভালো পাইতাম।'
ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুসহ কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে এবার ৩৪৪৫ হেক্টর জমিতে হলুদের আবাদ হয়েছে।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, 'কাঁচা হলুদ বিক্রি করলে কৃষকরা একটু লোকসানে পড়ে। আর সেটাকে শুকনো অবস্থায় বিক্রি করলে লাভটা বেশি পায়। কিন্তু আমাদের কৃষকদের সেই সক্ষমতাটা এখনো তৈরি হয় নাই।'
ফুলবাড়িয়ার হলুদের সুনাম থাকায় উপজেলার বাক্তা বাজারে বেশ কয়েকটি গোডাউনে দেখা মেলে মিয়ানমারের নিম্নমানের হলুদের। অভিযোগ রয়েছে বাড়তি লাভের আশায় কিছু ব্যবসায়ী এসব হলুদকে ফুলবাড়িয়ার হলুদ বলে বিক্রি করে।
হলুদ ব্যবসায়ীরা বলেন, 'বাইরের হলুদের সাথে আমাদের হলুদ মিশাইয়া তারা বিক্রি করে। এতে আমাদের হলুদের চাহিদাটা কমাইয়া দিছে। কোম্পানিরা যদি আমাদের হলুদগুলোকে প্যাকেট জাত করে তাহলে ব্যবসায়ী এবং কৃষকরা উপকৃত হবে।'
একই জমিতে পরপর তিনবার হলুদ আবাদ করলে 'রাইজোম রট' রোগের আক্রমণ ঘটে। এছাড়া বাইরে থেকে আমদানি করা হলুদের কারণে দাম কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা হন। এমন অবস্থায় উচ্চ ফলনশীল বিনা-১ জাতের হলুদের আবাদ বাড়ানো গেলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কয়েক বছরের মধ্যে আমদানির পরিমাণও কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরমানু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এর হর্টিকালচার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, '৭০ হাজার টন হলুদ আমরা আমদানি করি এতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা লোকসান হয়। সেহেতু আমরা চাচ্ছি বিনা হলুদ-১ জাতটাকে ছড়িয়ে দিতে। তাহলে আমাদের আমদানি নির্ভরতা অনেকটা কমে আসবে।'
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, 'আমাদের এই শাখাটাকে আরও তুলে ধরতে হবে। আর তুলে ধরার জন্যে আমাদের কৃষক ভাইয়েরা যাতে ভালো মূল্য পায় সেদিকে নজর দিতে হবে এবং আমদানি নির্ভরতা পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনতে হবে।'
অনেক ইতিহাসবিদের দাবি ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিশ্বে হলুদের ব্যবহার শুরু। অনুমান করা হয় এশিয়া অঞ্চলে এই মসলা এসেছিল ৩ হাজার ৭০০ বছর আগে।