দীর্ঘদিন ধরেই আলু চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাজারকেও বড় করছে আলু, নিঃসন্দেহে এটি খুশির খবর। তবে মৌসুম শেষে সেই খুশি কতটা ধরে রাখতে পারেন দেশের প্রান্তিক চাষিরা?
চলতি মৌসুমে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আলুর উৎপাদন। আর তাতেই যেন কপাল পুড়েছে চাষির। ন্যায্য দাম পেতে নাভিশ্বাস তাদের। পানির দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে আলু।
এমন বাস্তবতায় আলু উৎপাদনে নাম করা মুন্সীগঞ্জের চালচিত্র দেখতে চাই। চাষিরা জানালেন রাজ্যের হতাশার কথা। জেলার সিরাজদীখানের শফিউদ্দিন মোড়ল, ১০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে এবার লোকসান গুনছেন। হিমাগারের ভাড়া মিটিয়ে ৫০ কেজির আলুর বস্তা বিক্রি করছেন মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকায়। তাতে কেজিতে আলুর দাম পাচ্ছেন চার থেকে ছয় টাকা। খুচরা বাজারে যে আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ টাকায়। এ হলো আলুর বাজারের হালহকিকত।
শফিউদ্দিন বলেন, ‘আলু এখনও কোল্ড স্টোরেজে রয়েছে, সব বিক্রি হয়নি। ফলন যদি বেশি হয়ে থাকে, সেটা তো আর ডাবল হয়নি। আর যে পরিমাণে আলু হয়েছে সে পরিমাণে তো দাম হইলো না।’
তার মতো অনেকেই ঋণ নিয়ে আলু চাষ করে দিশেহারা। শত শত বস্তা আলু ফেলে রেখেছেন হিমাগারে। লোকসানে পড়া চাষির অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত কেজিপ্রতি ২২ টাকা দরে আলু কোথাও বিক্রি হচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
কৃষকদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা কারও না কারও থেকে কর্য করে নিয়ে চাষ করছি। কিন্তু এখন আমাদের যে অবস্থা, ১০০ বস্তা আলু বিক্রি করলে ১০ হাজার টাকা পাচ্ছি।’
সারা দেশে আলু সংরক্ষণের তিন শতাধিক হিমাগারের প্রায় ৬১টি রয়েছে এ শহরে। এসব হিমাগারে কী পরিমাণ আলু রয়েছে? সেটি জানতে চাই। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পুরনো আলু বের করার সময়সীমা থাকলেও শেষ সময়েও পড়ে আছে হাজার হাজার বস্তা আলু।
বিক্রি না হওয়া আলু নিয়ে এখানকার ব্যবসায়ীদের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। হিমাগার ও পরিবহন ভাড়া মিটিয়ে উৎপাদন খরচ না ওঠায় সরকারি প্রণোদনার দাবি তাদের।
ব্যবসায়ীদের মদ্যে একজন বলেন, ‘কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া দিয়ে আমরা ছালার (বস্তা) টাকা পাচ্ছি। আলুটা এনে যে স্টোরেজে রাখতে হয়েছে সে টাকা আমরা পাই না।’
হিমাগার কর্তৃপক্ষ বলছে, চুক্তি মেনে সময়মতো আলু খালাস না হলে সব পক্ষকেই টানতে হবে লোকসান।
নেপচুন হিমাগারের ম্যানেজার রুহুল আমিন বলেন, ‘আমাদের একেক বস্তায় খরচ পড়েছে এক হাজার ২০০ টাকা। সে আলু আমরা বিক্রি করছি ৪০০ টাকা।’
আরও পড়ুন:
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে বছরে আলুর চাহিদা প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লাখ টন। তবে গেল অর্থবছরে উৎপাদন ছাড়িয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টনের বেশি। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ছয় লাখ টন। গত মৌসুমে মুন্সীগঞ্জে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর আবাদি জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ টনের বেশি। যদিও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার আশঙ্কা তাদের।
মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক শান্তনা রাণী বলেন, ‘সরকার যদি আলু কিনতো। যে ঘোষণা দিয়েছিল, আলু যদি কেনা হতো তাহলে কৃষকরা একটু হলেও বেনিফিটেড হতো। এটা ছাড়াও যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেক্ষেত্রে আলু চাষিদের জন্য যদি বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেত, সেক্ষেত্রে কৃষকরা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারতো।’
আলুর রপ্তানি প্রক্রিয়াও খুব একটা সুখকর নয়। উৎপাদিত আলুর মাত্র এক শতাংশের মতো বিদেশে যায়। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আলুর বহুমাত্রিক ব্যবহারে পিছিয়ে বাংলাদেশ।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিদেশে আলু রপ্তানি বাজার খুঁজতে হবে নতুন করে। আরও বেশি পরিমাণে আলু কীভাবে রপ্তানি করা যায় সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশে আলুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। সেটা যদি করা যায়, আলুর উৎপাদন যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না।’
শুধু সবজি হিসেবে সীমাবদ্ধ নয় বরং রপ্তানি ব্যবস্থাপনা সহজ করা ও চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা গেলে লোকসানের আশঙ্কা থেকে বেরিয়ে এসে চাঙ্গা হবেন দেশের প্রান্তিক আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা।





